ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শনিবার, ১১ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৪ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

স্লোগান ও আন্দোলনের বাতচিত থাকুক জাগরুক, না হলে যে বাজবে মৃত্যুঘণ্টা

নাজমুস সাকিব

(৪ মাস আগে) ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৪:১১ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৫ পূর্বাহ্ন

ইতিহাস সরল রেখায় নির্মিত হয় না। বিপ্লবের ইতিহাসও তা-ই। বিপ্লব কখনো বলে-কয়ে হয় না। দীর্ঘ দিনের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম, বড় বড় অর্থনৈতিক আন্দোলন, শাসকগোষ্ঠীর অর্থনীতি বেলাইনে নিয়ে যাওয়া কিংবা বেলাইন ঠেকাতে না পারা কিংবা ঘরে-বাইরের সামগ্রিক পরিস্থিতির চাপে তাদের মস্তবড় ভুল পদক্ষেপ--এরকম নানাকিছুর সম্মিলনে কিংবা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মসূচির নামকরণ এবং বাস্তবায়ন, সঠিক স্লোগান বারুদ হয়ে উঠে, দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, বিপ্লবকে এগিয়ে দেয় অনেকটুকু, বাকিটা রাজপথের ফয়সালা। ২৪ -এর জুলাই বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সেই পথেই ঘটেছে নিজস্ব স্বকীয়তা সমেত।

জুলাই অভ্যুত্থানের ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গগনবিদারী, ইউনিক স্লোগান ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ ছিল ভয়ংকর সুন্দর। এই স্লোগানের দুই মাসপূর্তিতে স্লোগানের ইতিহাস আবারও সামনে এসেছে। তর্ক-বিতর্ক চলছে জোরেশোরে, বয়ান তৈরির চেষ্টাও চলছে। চলুক। বাতচিত অব্যাহত থাকুক। বাতচিত মরে গেলে সফল আন্দোলনেরও কবর রচিত হয়।  

এখন দেখা যাক, রাজাকার শব্দটি কীভাবে আমাদের প্রাণস্পন্দন হলো। বিষয়টা আগেই বলেছি ভয়ংকর সুন্দর। পতিত সরকারের প্রোপাগান্ডা মেশিন দালাল মিডিয়াগুলো আন্দোলনকারীদের রাজাকার বানানোর আয়োজনে জড়িত ছিল। আর ‘রাজকুমারী হাসিনা’ তার পরীক্ষিত ট্রাম্পকার্ড খেললো। রাজাকার আখ্যা দিল ছাত্রদের। মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করল। অনেকেই বিভক্ত হয়ে গেল সত্যি সত্যি। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্র-ছাত্রীরা আওয়াজ তুলল--‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’। মুহুর্মুহু স্লোগানে ক্যাম্পাস সরগরম, ইন্টারনেটেও ঝড়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একি স্লোগান, ক্ষোভের আগুন। ফেসবুকে সরকারপক্ষীয়দের বিষ-তীর, জাত গেল জাত গেল বলে, ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীলরাও পড়ল বিপাকে, রয়ে-সয়ে স্ট্যাটাস। তখন আরও পরে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছাত্ররা সাথে আরও স্লোগান যোগ করল, যেমন--‘কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। কিন্তু শেষের স্লোগানগুলো তেমন একটা শোনা যায়নি। সরকার বুঝতেই পারে না এটা বুমেরাং হতে পারে। সাগরে ঝড় উঠলে অভিজ্ঞ সারেং বা নাবিকরা ঝড়ের মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে ফেড়ে বের হয়ে বাঁচে। পতিত সরকার গ্রেনেড ছুড়েছিল, ছাত্ররা সেটা ধরে ফেলে উল্টো তাদের দিকেই ছুঁড়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে গদি।

রাজাকার স্লোগানের সাথে পরবর্তীতে আরো স্লোগান যুক্ত হয়েছে, আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছে। মানুষ সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, গালি যুক্ত হয়েছে, স্যাটায়ার যুক্ত হয়েছে--‘আপস না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম’; ‘দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ’; ‘আমার সোনার বাংলায়/ বৈষম্যের ঠাঁই নাই’; ‘দিয়েছি তো রক্ত/ আরও দেব রক্ত’, ‘পুলিশ আমার শাওয়া, ভাদ্র মাসের কাউয়া’ ইত্যাদি।    

পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হলের ছাত্রীদের শেখ হাসিনার রাজাকার কেন্দ্রিক কটাক্ষ, ছাত্রদের উপর বিশেষ করে মেয়েদেরকে ছাত্রলীগ দ্বারা বর্বরোচিত আক্রমণ, এমনকি ঢাকা মেডিকেলে পর্যন্ত আক্রান্তদের উপর হামলা ছাত্র-জনতাকে খেপিয়ে তুলেছিল, ছাত্রলীগ শেষপর্যন্ত বিতাড়িত হয়েছিল। আন্দোলন মোহাম্মদপুরেও ছড়িয়ে পড়েছিল, যোগ দিয়েছিল রিকশা শ্রমিকরাও। আর যেটা প্রচার পায়নি সেটা হলো মোহাম্মদপুরের গার্মেন্টস শ্রমিকরা ছাত্রদের সমর্থনে নেমে এসেছিল। প্রচণ্ড ফাইট করেছিল। একটা বিষয় লক্ষণীয়, ছাত্রদের সাথে শ্রমিকদের মাঝে মাঝে গ্যাঞ্জাম লাগলেও ছাত্রদের উপর অত্যাচার হলে শ্রমিকরা সহ্য করতে পারে না, শ্রমিকরা বুক পেতে দেয়।

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের বীরোচিত গুলিবরণ কোটি মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাড্ডা এলাকায় যে বিরোচিত ভূমিকা পালন করল তাদের ছাত্র ভাইদের উপর হামলা করার কারণে, তা ছিল অবিশ্বাস্য। যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষ, মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রচণ্ড প্রতিরোধ, উত্তরা ও গাজীপুরে সব বীরত্বের ঘটনা। লাশের পর লাশ। লাশ তো জীবন্ত মানুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।  

এবারের জুলাই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানে অনেকগুলো মোমেন্টাম বা বাক-বদল ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। বৈষম্য শব্দটি এনে তারা আন্দোলনের ফ্রেমকে বড় করে রেখেছিল। সরকারের প্রচ্ছন্ন চাওয়াতে (কারণ অ্যাটর্নি জেনারেল মুভ করেননি) হাইকোর্টের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা পুনরুজ্জীবিত হওয়া কারণ কোটাপ্রথা বাতিল করাতে পরিকল্পনামাফিক ম্যান নিতে পারায় সরকারের লাইফ-লাইন হুমকির মুখে ছিল। করোনা ভাইরাস তাতে অনেকটা ঠ্যাক দিয়ে রেখেছিল। আদালতের বদলে সরকারকে ছাত্রসমাজের চ্যালেঞ্জ একটা ইউনিক ব্যাপার ছিল, এখানে লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক এবং বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম (আবদুল্লাহ)-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সেটা তার ঐ সময়কার ফেসবুক একটিভিটিস থেকেও বুঝা যায়। এতে করে সরকার ভড়কে যায়, কিন্তু দেখতেও চাইছিল আন্দোলনের শক্তিমত্তা কতটুকু। তারপর ছাত্রদের আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির নামকরণ--‘বাংলা ব্লকেড’, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ইত্যাদি দেশব্যাপী আলোড়ন তুলে। সাধারণ মানুষ নতুনত্ব খুঁজে পায়, 
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও কাড়তে থাকে। এই কর্মসূচির নামকে কেন্দ্র করে পিনাকী ভট্টাচার্যও সমালোচনা করে, সেটাকে মাহফুজ আলম বলতে গেলে গুড়িয়ে দেয়, কারণ মাহফুজরা তো মাঠে ছিল, পিনাকী ছিলেন প্যারিসে, তিনিও যে তথ্য পান সেটা দিয়ে মাঠের কার্যক্রম চালানো যায় না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল-ছাত্ররা কোনোভাবেই আদালতকে বিশ্বাস করে নাই, সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেয় নাই, সেটা কোটার বেলায় এবং ছয় ছাত্র সমন্বয়ককে হাইকোর্টের মাধ্যমে মুক্তির বেলায়ও। বরং সন্দেহের চোখে দেখেছে এবং তারাই সঠিক। রাজনৈতিক ব্যাপার রাজপথেই ফয়সালা হতে হয়, আদালতে নয়।

আন্দোলনের স্লোগান পরিস্থিতির বারবার নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। যেমন ভিকারুন্নিসার মেয়েরা স্লোগান দিয়েছে-‘পা চাটলে সঙ্গী, না চাটলে জঙ্গি’। শেষমেষ এক দফাতে এসে আন্দোলন পরিণতি পেয়েছে। মহারানী হাসিনা পালিয়েছে, সরকার পতন হয়েছে। অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ সফলতা পেয়েছি কি?

সমন্বয়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা নাহিদও স্বীকার করেন, ‘দ্বিতীয় অভ্যুত্থান’ লাগবে। কিন্তু সেটা সহিংস হবে ব্যাপারটা এমন নয়। জুলাই অভ্যুত্থানে মানুষ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন চেয়েছে যেকোনো মূল্যে। প্রকট অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মুক্তি চেয়েছে, দ্রব্যমূল্যের কষাঘাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে, কর্মসংস্থান চেয়েছে। কিন্তু সেটার জন্য রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন দরকার, সংবিধান সংস্কার নয় পুনর্লিখন দরকার। কিন্তু সেটার জন্য জনমানস তো প্রস্তত নয়। ফলে নতুন স্লোগান লাগবে, নতুন কর্মসূচি লাগবে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানের জন্য।

জুলাই অভ্যুত্থানের স্লোগান, ভাষা নির্মাণ, ইতিহাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলুক, বাতচিত জাগরূক থাকুক। নীরবতা খুনের চেয়েও খারাপ, মৃত্যুঘণ্টা বাজার জন্য যথেষ্ট। শুধু খেয়াল রাখতে হবে তর্ক-বিতর্ক যাতে বিপৎসীমা অতিক্রম না করে, পরাজিত শক্তি যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে।    

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

পাঠকের মতামত

চলমান বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

হেদায়েত উল্লাহ
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৯:১১ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status