অনলাইন
বিবিসির নিবন্ধ: উগ্র ডানপন্থীরা বাংলাদেশে মুসলিম হামলা সম্পর্কে গুজব ছড়াচ্ছে
মানবজমিন ডিজিটাল
(৮ মাস আগে) ১৯ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, ৫:০৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৫:৩২ অপরাহ্ন
বাংলাদেশে হামলার যে ভিডিওগুলি সামনে আসছে সেগুলি মর্মান্তিক। কোথাও দেখা যাচ্ছে বাসাগুলি আগুনে জ্বলছে, কোথাও আবার নারীরা অঝোর নয়নে কাঁদছে, সাহায্যের জন্য আকুল আর্তি জানাচ্ছে। চারদিকে সহিংসতার ভয়ঙ্কর চিত্র। দীর্ঘদিনের নেত্রী শেখ হাসিনার আকস্মিক পতনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে "হিন্দু গণহত্যা" চলছে , এই দাবি করে ভিডিওগুলি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একজন বৃটিশ অতি-ডানপন্থী কর্মী স্টিফেন ইয়াক্সলে-লেনন, যিনি টমি রবিনসন নামটি ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যের দাঙ্গার সময় উস্কানিমূলক পোস্ট করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন - তিনিও বাংলাদেশের ভিডিওগুলি শেয়ার করেছেন। কিন্তু বিবিসির দাবি , অনলাইনে শেয়ার করা অনেক ভিডিও এবং দাবি আদপে মিথ্যা।
হিন্দু মন্দিরে হামলার মিথ্যা দাবি
বাংলাদেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে শিরোনামে রয়েছে: ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ। যার ফলে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।সরকারের পতন ঘটে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান। বিজয় উদযাপন ক্রমেই হিংসাত্মক রূপ নেয়। দাঙ্গাবাজরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্যদের টার্গেট করে, যে দলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সদস্যই বিদ্যমান। খবর আসতে থাকে সহিংসতা এবং লুটপাট বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগণ ও তাদের সম্পত্তিকে প্রভাবিত করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী ভারতে অতি-ডানপন্থী
ইনফ্লুয়েন্সাররা মিথ্যা ভিডিও এবং তথ্য শেয়ার করে ঘটনাগুলি সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ভিডিও তুলে ধরে দাবি করছে, এর পেছনে "ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের " হাত রয়েছে। একটি ভাইরাল পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে একটি মন্দিরে "বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা" আগুন ধরিয়ে দিয়েছে । বিবিসি যাচাই করে দেখেছে যে, চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দির হিসেবে চিহ্নিত এই ভবনটি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। যা ঘটেছে তা আওয়ামী লীগের দলীয় অফিসের সামনে । অগ্নিকাণ্ডের পর বিবিসি-র প্রাপ্ত ছবিতে আওয়ামী লীগ সদস্যদের মুখসহ পোস্টারের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে ।মন্দিরের একজন কর্মী স্বপন দাস বিবিসি-কে জানান, ৫ আগস্ট বিকেলে মন্দিরের পেছনে আওয়ামী লীগ অফিস চত্বরে হামলা হয়। তারা অফিসের আসবাবপত্র বাইরে নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যদিও সেদিন মন্দিরে কোনো হামলা হয়নি, তবে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ রয়েছে। মন্দিরটির সামনে পাহারা বসিয়ে আপাতত সেটি বন্ধ রাখা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং টুল ব্র্যান্ডওয়াচ অনুসারে, মন্দিরে হামলার যে ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ আলাদা। বেশিরভাগই একই হ্যাশট্যাগের অধীনে, যা ৪ আগস্ট থেকে প্রায় এক মিলিয়ন বার শেয়ার করা হয়েছে । যে অ্যাকাউন্টগুলি থেকে এই ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে সেগুলি বেশিরভাগই ভারতের।
অন্যান্য ভাইরাল পোস্টগুলির মধ্যে একটিতে দাবি করা হয়েছে যে একজন বাংলাদেশি হিন্দু ক্রিকেটারের বাসা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিবিসি যাচাই করে দেখেছে, বাসাটি আওয়ামী লীগের একজন মুসলিম এমপির। একটি স্কুলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ভিডিওতে দেখানো হয়েছে। বিবিসি সেটি পরিদর্শন করে জানিয়েছে হামলার পেছনের কারণ ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। এই সমস্ত পোস্টগুলি একাধিক অ্যাকাউন্ট দ্বারা শেয়ার করা হয়েছে, যার অনেকগুলি হিন্দু-জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধকে সমর্থন করে। বাংলাদেশে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও অপপ্রচার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সাঈদ আল-জামান বলছেন - আন্তঃধর্মীয় উত্তেজনা দেশে বহু দশক ধরে বিদ্যমান। শেখ হাসিনার তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার পর, বিষয়গুলো আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যেহেতু কার্যকর সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলার অভাবে হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কিন্তু মিথ্যা কাহিনী পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। এই ইনফ্লুয়েন্সাররা ভয়-ভীতি-উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলছে।'
বিশ্বব্যাপী বিস্তার
এই পোস্টগুলির মধ্যে বেশ কিছুতে মিথ্যে দাবি করা হয়েছে যে মুসলমানরা হিন্দুদের টার্গেট করছে। যে অ্যাকাউন্টগুলি থেকে এগুলি শেয়ার করা হয়েছে সেগুলি হয় বাংলাদেশ নতুবা ভারত থেকে আগেই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। টমি রবিনসন যিনি যুক্তরাজ্য জুড়ে মুসলিম এবং অভিবাসীদের লক্ষ্য করে সহিংস দাঙ্গার বিষয়ে উস্কানিমূলক বার্তা পোস্ট করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন, তিনিও বাংলাদেশের অযাচাইকৃত ভিডিওগুলি শেয়ার করে লিখেছেন - "হিন্দুদের উপর গণহত্যা"। বিবিসি তার শেয়ার করা একটি ভিডিও যাচাই করে দেখেছে । সেখানে দেখা গেছে ,একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইছেন, কারণ তার বাসায় হামলা হয়েছে৷ টমির পোস্টটিতে মিথ্যাভাবে দাবি করা হয়েছে যে বাসায় হামলা চালায় "ইসলামপন্থীরা'। মূল ভিডিওটি শেয়ার করা হয়েছিল ৬ আগস্ট, হামলার একদিন পর।বিবিসি যখন ভিডিওটির পেছনের গল্পটি জানতে তদন্ত শুরু করে, তখন একটি ভিন্ন বিষয় সামনে আসে। স্থানীয় ছাত্রদের একটি দল যারা ওই নারীর সম্পত্তি রক্ষায় সহায়তা করেছিল তারা বিবিসিকে জানায় বিরোধটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। মূল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে সম্পত্তির ভিতরের হিন্দু মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিরোধটি আসলে ছিল জমির মালিকানা নিয়ে। অনেক আগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। প্রায় ছয় মাস ধরে জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় আদালতে মামলা চলছে। স্থানীয়রাও জানিয়েছেন, হামলাটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না এবং অভিযুক্তদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই ছিল। তারা আরও জানিয়েছে যে এলাকার অন্যান্য হিন্দু পরিবার এবং মন্দিরগুলি অক্ষত রয়েছে।
যদিও টমি রবিনসন এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হয়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে ঠিক কী ঘটেছে তা বের করা বেশ কঠিন। অনেক বাস্তব ঘটনা এবং হামলা সারা দেশে ঘটেছে, কিন্তু কোনটার পেছনে ধর্ম রয়েছে , আর কোনটা রাজনৈতিক সেগুলির মূল্যায়ন করা বেশ কঠিন। আসলে দুটোই একে ওপরের সাথে সম্পৃক্ত। একজন হিন্দু বাসিন্দা ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে সংখ্যালঘুদের শেখ হাসিনার ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ দলের সমর্থক হিসাবে দেখা হয়। বাংলাদেশের জন্য এএফপির ফ্যাক্ট-চেকার, কাদেরউদ্দিন শিশির বিবিসিকে বলেছেন যে হিন্দু মালিকানাধীন সম্পত্তিতে হামলা হয়েছে ঠিকই । কিন্তু,ডানপন্থী ভারতীয় অ্যাকাউন্টগুলি এই রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণগুলিকে ধর্মীয় রং দিচ্ছে ।" সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, পাঁচ হিন্দু ব্যক্তির নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে। দুইজনকে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে। এএফপি দাবি , আওয়ামী লীগের মুসলিম নেতাদের সংখ্যা ৫০ জনেরও বেশি ।
ছাত্ররাই হিন্দু মন্দির রক্ষা করছে
হিন্দুদের উপর হামলার মিথ্যা খবর অনলাইনে ভাইরাল হলে, কিছু মুসলিম আন্দোলনকারী হিন্দু মন্দির পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। চট্টগ্রামের বাইরে হাটরাজীর একটি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মইনুল বলছেন - 'তাদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সংঘাত উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আমরা এই ফাঁদে পা দেব না। 'এলাকার একজন স্থানীয় হিন্দু ছোটন বনিক, যিনি মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলছেন - " তারা এই সংকটময় সময়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি আশা করি ভবিষ্যতেও এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হিন্দু-মুসলিম একসাথে থাকব।