মত-মতান্তর
দুটো রাজনৈতিক কুইজ ও রাজনীতির আগামী
ড. তারেক ফজল
(৫ মাস আগে) ৯ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবার, ২:৩২ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন
'বীরশ্রেষ্ঠ' শহীদ আবু সাঈদসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব বীর শহীদের জন্য শ্রদ্ধা ও তাদের খুনিদের জন্য গভীর ঘৃণা জানাই।
বাংলাদেশ আবার স্বাধীন হয়েছে, ৫ আগস্ট (জনপ্রিয় হয়েছে ৩৬ জুলাই হিসেবে) ২০২৪ তারিখে। স্বাধীন হয়েছে? ভয়ংকর কথা! হ্যাঁ, বাংলাদেশ আবার স্বাধীন হয়েছে। এটা আমার একার উচ্চারণ নয়, দাবি নয়। তবে বলতে পারেন, আমি সম্ভবত অনেকের আগে উচ্চারণটি করেছি, 'আকাশের ঠিকানায়' (ফেইসবুকে)। লিখেছিলাম 'স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাগতম'। দেখলাম, অনেকে এ উচ্চারণটি সাদরে গ্রহণ করেছেন। এরপর রাজনীতিক, নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ একই উচ্চারণ করেছেন। ফ্রান্স থেকে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বৃহস্পতিবার এই 'দ্বিতীয় স্বাধীনতার' কথা উচ্চারণ করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য দিনটিকে বলতে চান 'ঈদ উন নাজাত' (মুক্তির ঈদ বা আনন্দ)।
পাঠকের সাথে দুটো রাজনৈতিক কুইজ ভাগাভাগি করতে চাই।
বাংলাদেশি কেউ একজন ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে (দুই হাজার সাড়ে নয় সাল!) বলেছিলেন (প্রেডিকশন- ভবিষ্যদ্বাণী?), 'শেখ হাসিনার এই সরকারকে আর ঘোষিত রাজনৈতিক (গণতান্ত্রিক?) প্রক্রিয়ায় সরানো যাবে না। অঘোষিত অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরকার হটানোর 'বাংলাদেশি মডেল'টিও আর কাজ করবে না। এই সরকারের পতন হবে 'না জানা কোনো পন্থায়', হয়তো আগের চেয়েও করুণ পরিণতিসহ।'
ওই ভবিষ্যদ্বাণীটা কতোটা সঠিক ছিলো, তা বোঝার চেষ্টা করা যায়। শেখ হাসিনার সরকারকে ঘোষিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরানো যায় নি, তা বলা এখন 'বাহুল্য' বটে। মি. ওবায়দুল কাদের এক সভায় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, 'দেখতে দেখতে ১৫ বছর গেলো, আরো যাবে পাঁচ বছর। মানুষ বাঁচে কয় বছর? আন্দোলন হবে ঈদের পরে, রোজার পরে। আন্দোলন আর হয় না।'
তিনি বাহ্যত অহংকার দেখালেও অশুদ্ধ বলেন নি। আন্দোলন আর নির্বাচনী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা সরকারকে সরানো যায় নি। তিনি নিজে হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়েছেন ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ দুপুরে।
তার আগে প্রেসিডেন্ট বরাবরে পদত্যাগ করেন তিনি। তার দেশত্যাগকে লোকেরা বলছেন 'পলায়ন', বলছেন এখন থেকে 'পলায়ন দিবস' পালিত হবে, 'প্রত্যাবর্তন দিবস' নয়। নেত্রীর দেশ ছাড়ার পর অন্য নেতা-কর্মীরাও যে যার মতো দেশ ছেড়েছেন বা আত্মগোপন করেছেন। মানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।
এই পতন যেভাবে হলো তা অবশ্যই অস্বাভাবিক ও অভূতপূর্ব। সরকারের এই পতন হঠাৎ করে একটি বিশাল ও ব্যাপক শূন্যতা সৃষ্টি করে। এই শূন্যতার সুযোগে অপরিচিত দুর্বৃত্তরা বেশ কিছু স্থাপনা ও বাড়িঘর ভাঙচুর করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের পতন চেয়ে শুরু হয় নি। চেয়েছিলো সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থার উপযুক্ত সংস্কার। সেটি ক্রমশ গুরুতর হয়, দাবি বাড়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কথিত 'বিকৃত উচ্চারণ'-এর (রাজাকারের নাতি-পুতি) জন্য ক্ষমা চাওয়ায় গড়ায়। এ পর্যায়ে মি. ওবায়দুল কাদেরের 'ছাত্রলীগ থ্যারাপি' পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, 'আবু সাঈদেরা' শহীদ হয় এবং শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ দাবি ওঠে। এ দাবি আদায়ে মাত্র তিন দিনের চমকপ্রদ কর্মসূচির ফলেই পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। তার আগে কয়েকশো বা হাজার প্রাণহানি ঘটে।
দেখা যাচ্ছে, 'অচেনা এক ছাত্র গণঅভ্যুত্থানেই' এ সরকারের পতন হয়। শাসক হিসেবে শেখ হাসিনা 'জীবনে বেঁচে আছেন'। তবে এ জীবন শান্তির নয়, স্বস্তির নয়, আনন্দের নয়। এ জীবন এগুলোর ঠিক উল্টো। এ জীবন মৃত্যুর চাইতে বেশি কঠিন মনে হতে পারে। এ জীবন লজ্জার, অপমানের, অবমাননার।
শেখ হাসিনা এখন তেমন একটি জীবনে ঢুকলেন, স্পষ্টতই। তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি নয় বহু দেশ, ভাবার বিষয় বটে। পলাতক জীবন তাঁর, এ উচ্চারণই সব লজ্জা, অবমাননার স্মারক। সুতরাং বলা যায়, মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর পিতার শাসন অবসানের চেয়ে তাঁর শাসনের অবসান বেশি করুণ, বেশি হৃদয়বিদারক।
তবে কি বলা যায়, শেখ হাসিনার শাসন অবসান বিষয়ে সেই বাংলাদেশির ভবিষ্যদ্বাণী বেশ সঠিক হয়েছে, যথেষ্ট মিলে গেলো? সম্ভবত বলা যায়। কে সেই রাজনীতির ভবিষ্যৎবক্তা, চেনেন? মেইল-মেসেঞ্জারে জানাতে পারেন।
দ্বিতীয় কুইজটি আমার। রাজনীতি বিজ্ঞানের পণ্ডিত প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অনেকের জন্য বটবৃক্ষসম। তিনি অভিভাবকের অবস্থান থেকে বহুজনের জন্য উদারতার সাথে অবদান রাখতেন। আমার জন্য তার স্নেহ ছিলো, আদর ছিলো। তাঁর বাড়ি গেলাম এক বিকেলে, ২০১৪ সালের কোনো একদিন। স্যারকে বললাম, 'স্যার একটা কুইজ আপনার জন্য, করতে পারি?'- দুষ্টু-মিষ্টি সুরে। 'কী বিষয় বাপু, বলো দেখি'- স্যার সায় দিলেন। 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিকরাই বাতিল করবে আগামী ২০-২৫ বছর পরে, এই ভবিষ্যদ্বাণী কে করেছিলেন?'
স্যার আমতাআমতা করলেন খানিক। এবং বললেন, 'না বাপু পারছি না।' হাসতে হাসতে বললাম, 'সঠিক জবাব প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ'। স্যার আমার দিকে কিঞ্চিৎ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। বললাম, ১৯৯৬ সালে (০৮ নভেম্বর ১৯৯৬, ঢাকা) সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে আমার একটি প্রবন্ধভিত্তিক সেমিনারে আপনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। সেখানে আপনি বলেছিলেন, যেই রাজনীতিকগণ এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা করলেন, আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে তারাই এ ব্যবস্থা বাতিল করবেন। সেটিসহ চারটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির পরিশিষ্টে সেই সেমিনারটির নিউজ ক্লিপ সংযোজিত হয়। স্যারের লাইব্রেরিতে থাকা আমার সেই বইটি বের করে স্যারকে দেখালাম তাঁর সেই বক্তব্য। স্যার তা দেখে খুশি হলেন। মানে, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৯৬ সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পরবর্তী ২০-২৫ বছরের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়নকারী রাজনীতিকগণই বাতিল করবেন। কথা হচ্ছিলো ২০১৪ সালে। আর শেখ হাসিনা নিজ উদ্যোগে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক ব্যবস্থাটি বাতিল করেন। তার মানে, রাজনীতি বিজ্ঞানীগণ তাদের দূরদৃষ্টি দিয়ে রাজনৈতিক অগ্রগতি বিষয়ে কার্যকর ভবিষ্যদ্বাণী করার যোগ্যতা রাখেন।
নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের ভিত্তি হলো ছাত্রদের নেতৃত্বে সফল হওয়া ৫ আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান। এই গণঅভ্যুত্থান পুরো রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ে তোলার অধিকার দেয়। কিন্তু এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে বিপ্লব সাধনের অঙ্গীকার করে নি। তাই একটি বিপ্লব সফল হবার পর যেভাবে একটি রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে চায়, এই অভ্যুত্থানটি থেকে সেই ধরনের ভূমিকা আশা করার সুযোগ কম। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা বদলে দেয়ার জন্য, খাঁটি অর্থে, একটি সংবিধান সভা (কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি) গঠন করা কাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তেমন একটি সংবিধান সভা শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় গঠন করার ব্যবস্থা করতে পারেন। সেই সংবিধান সভা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতির জন্য একটি 'গঠনতন্ত্র' (কন্সটিটিউশন - সংবিধান) তৈরি করতে পারে। তারপর সেই সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদের জন্য সদস্যদের নির্বাচন করার মাধ্যমে জাতিকে দীর্ঘমেয়াদী নেতৃত্ব বাছাই করা যেতে পারে। সুতরাং এখন বাংলাদেশ যা প্রত্যক্ষ করছে, তার মধ্যে পুরো 'সাংবিধানিকতার অনুশীলন' খোঁজার সুযোগ কমই বটে।
কী করবে এ সরকার?
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুটে কাজ অবিলম্বে করবে বলে আশা করা হচ্ছে : জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষকে চাঁদাবাজিসহ অন্যবিধ অরাজকতা দমন করে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রির মূল্য গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ে আসা।
(ইমেইল- [email protected])
আমাদের খুবই প্রাজ্ঞ ও ঠান্ডা মাথার স্যার। অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমরা আরেকজন বিজ্ঞ রাষ্ট্র বিজ্ঞানী পেয়েছি। ড. তারেক তওফীকুর রহমান। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গাইড লাইন দিতে আপনার মতো পরিশ্রমি, মেধাবী রাষ্ট্র বিজ্ঞানিদের এগিয়ে আসা দরকার। তাদের কাছে রাষ্ট্র মেরামতের ফর্মুলা তোলে ধরার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি আপনার প্রতি।
আমি একজন প্রাক্তন সেনাসদস্য হিসাবে গর্বভরে বলতে পারি, সেনাবাহিনী জনগণের পাশে ছিল এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।
আজ আমার ধারণাও বাস্তবে রুপ নিলো।৪/৫ বছর আগেবন্ধুদের বলতাম আগামী দশ বছরের মধ্যে দেশে একটি বিপ্লব ঘটবে এবং তার নেতৃত্বে থাকবে হঠাৎ করে তৈরি কিছু ছাত্র নেতৃত্ব। পাচ বছরের মধ্যেই ঘটে গেলো।বিশ্লেষণের সুত্র ছিলো অরাজকতা আর দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি।