ঢাকা, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, রবিবার, ২৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

শিশু হোসাইন বলেছিল

মা আমি ছোট্ট আমারে কেউ গুলি করে মারবে না

হাছান গাজী, দেবিদ্বার (কুমিল্লা) থেকে
২ আগস্ট ২০২৪, শুক্রবারmzamin

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে হোসাইন মিয়া। পরে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ জোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে চিটাগাং রোড এলাকায় বাসে বাসে ফেরি করে বেড়াতো ১০ বছরের ছোট্ট হোসাইন। গত ২০শে জুলাই বিকাল ৩টার দিকে ভাত খেয়ে বাসা থেকে বের হয় হোসাইন। এরপর আর হদিস নেই তার। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে বাবা মানিক মিয়া সন্তানের খোঁজে বের হন। টিয়ারশেলের গ্যাস ও  আগুনের ধোঁয়ায় রাস্তা তখনো অন্ধকার। এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধান না পেয়ে দুইঘণ্টা উল্টো পথে হেঁটে বাসায় এসে দেখেন, তার ছেলে এখনো বাসায় ফেরেনি। এরপর দুই মেয়েকে ঘরে তালাবদ্ধ রেখে স্ত্রী মালেকাকে সঙ্গে নিয়ে আবার খুঁজতে বের হন। রাত ৯টার দিকে কেউ একজন মোবাইল ফোনে আহত হোসাইনের ছবি দেখান। মানিক ও মালেকা বেগম সন্তানের ছবি দেখে চিনতে পারেন। এরপর তারা জানতে পারেন তাদের সন্তানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এরপর তারা একটি পিকআপ চালককে হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে কোনোরকম যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যান সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে একটি রিকশা করে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান। এরপর হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলেকে। কোথাও না পেয়ে কর্তব্যরত এক চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারেন ‘চিটাগাং রোড থেকে যারা আহত হয়ে আসছে তাদের চিকিৎসা চলছে। এরপর তারা রাত ২টা পর্যন্ত হাসপাতালে ছেলেকে দেখার জন্য বসেছিলেন। রাত ২টার পর একজন লোক এসে মানিক মিয়াকে মুঠোফোনে একটি ছবি দেখিয়ে বলেন এটি কি আপনার সন্তান? মানিক মিয়া ছবি দেখে হ্যাঁ বললে তিনি মানিক মিয়াকে মর্গে নিয়ে যান। মানিক মিয়া মর্গের ভিতর গিয়ে দেখেন লাশের স্তূপের ওপর তার ছেলের গুলিবিদ্ধ নিথর মরদেহ পড়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া সংজ্ঞা হারান। মা মালেকা বেগমের বুকফাঁটা চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে পুরো মেডিকেল এলাকা।   

গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া ছোট্ট হোসাইনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার বরিশল গ্রামে। তার নানার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার রাজামেহার ইউনিয়নের বেতরা গ্রামে। হোসাইন তার মা-বাবার সঙ্গে চিটাগাং রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতো। মানিক-মালেকা দম্পতির মাহিনুর আক্তার (৮) ও শাহিনুর আক্তার (৬) নামের দুই মেয়ে আছে। নিহত হোসাইনের লাশ গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার বরিশল গ্রামে না নিতে পেরে ২২শে জুলাই রাত ২টার দিকে নানার বাড়িতে দাফন করা হয়। 

২৭শে জুলাই শনিবার বিকালে হোসাইনের নানার বাড়ি দেবিদ্বারের বেতরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মা মালেকা বেগম ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আর্তনাদ করছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা স্বান্ত্বনা দিতে এসেও চোখে পানি ধরে রাখতে পারছেন না। কেঁদে কেঁদে মালেকা এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ভাত খেয়ে ঘরে থাকতে বলছিলাম, ছেলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, আমি বার বার ডেকে ঘরে আনার জন্য যাই, আর বলি বাবা রাস্তায় গোলাগুলি হচ্ছে তুই বাসায় চলে আয়, ছেলে বলে মা আমি ছোট্ট আমারে কেউ গুলি করে মারবে না? আমি গার্মেন্টে কাজ করতাম। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার ছেলে বলে মা তুমি চাকরি ছেড়ে দাও আমি তোমার চিকিৎসার জন্য বাসে বাসে ফেরি করবো। আমার ছেলে বাসে বাসে পপকর্ন, আইসক্রিম ও চকলেট বেচে যা আয় করতো তা পুরোটা আমার চিকিৎসার খরচ দিতো। আমার সোনার মানিকের কী অপরাধ ছিল তাকে কেন গুলি করে মারা হলো?

হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া বলেন, আমার ছেলে শনিবার বিকালে মারা গেছে। এই লাশ আনতে গিয়ে কতো বিপদেই না পড়ছি। এই অফিসে যাও, হেই অফিসে যাও। থানায় গিয়া জিডি করো। কতো স্বাক্ষর দিছি। এরপর সোমবার ছেলের লাশ পাইছি। এই লাশ লইয়া আইতে গিয়া আরও কতো বিপদে পড়েছি। সোমবার রাত ২টার দিকে দেবিদ্বার নানার বাড়িতে জানাজা ও দাফন হয়।

এ বিষয়ে দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ছোট্ট হোসাইনের নানার বাড়িতে আমি গিয়েছি। তাদের আর্তনাদ দেখে আমি নিজেও সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। উপজেলা প্রশাসন থেকে নিহত হোসাইনের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও তার পরিবারকে আরও সহযোগিতা করা হবে।
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status