শেষের পাতা
ফের কমছে রিজার্ভ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৩১ জুলাই ২০২৪, বুধবারউন্নত বিশ্বে বিদ্যমান উচ্চ সুদের হার বাড়ছে। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি সংকট কাটাতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে কমে গেছে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোর উচ্চ সুদের হার আগামীতে অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো কঠিন হতে পারে। এদিকে গত ৩০শে জুনের পর রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। সে কারণে দেশের রিজার্ভ এখন কতো, তা জানে না দেশবাসী।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’- নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন যে ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রকাশ করা হচ্ছে- তাতে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ওঠা-নামা হলেও রিজার্ভের তথ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমনকি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১.৪২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পরও রিজার্ভের পরিমাণ কমিয়ে দেখানো হয়নি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি আইএমএফ’র হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) এবং নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব করতে হবে। সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে গত বছরের জুলাই থেকে ‘গ্রস’ হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ হিসাবেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হয় না; আইএমএফকে জানানো হয়।
বিপিএম-৬ ও ‘গ্রস’ হিসাবের বাইরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভ থেকে আকুর দায়, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা অর্থ এবং আইএমএফ’র স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ডলার বাদ পড়বে। আর এসব বাবদ বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভ থেকে সাড়ে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বাদ দিয়ে রিজার্ভের প্রকৃত বা নিট হিসাব করতে হয়।
এক মাস আগে ২৭শে জুন ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯.৪৭ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪.৬২ বিলিয়ন ডলার।
গত ২৮শে জুন আইএমএফ’র ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের তৃতীয় কিস্তি ১.১৫ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের রিজার্ভে যোগ হয়। এ ছাড়া বাজেট সহায়তার ঋণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার যোগ হয় রিজার্ভে। সবমিলিয়ে ওইদিন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়ে হয় ২৭ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষদিন ৩০শে জুন বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১.৭৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলার।
এরপর জুলাই সাসে ৩ বার ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’- প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে পরিবর্তন দেখা গেলেও রিজার্ভের তথ্য ছিল ৩০শে জুনেরই। অর্থাৎ বিপিএম-৬ হিসাবে দেশের রিজার্ভ ছিল ২১.৭৯ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ চলতি সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার (২৫শে জুলাই) ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’- প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতেও রিজার্ভের তথ্য ৩০শে জুনের হিসাবই প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৯ই জুলাই আকুর মে-জুন মেয়াদের ১.৪২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদনে ৩০শে জুনের রিজার্ভই প্রকাশ করা হয়েছে। আকু হলো- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়।
রিজার্ভ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমি বলতে পারবো না। দুই/এক দিন পরে জানানো হবে।
গত ৯ই জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আকুর মে-জুন মেয়াদের ১.৪২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ২০.৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ: রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিবেদন থেকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধের সর্বশেষ প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল দুই ক্ষেত্রেই ছাড়িয়েছে অতীতের সব রেকর্ড। প্রতিবেদনে গত অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। মোট ১৩৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে সুদ বাবদ। আগের অর্থবছর ছিল ৯৪ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় সুদ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছর ছিল ৯ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ ৫ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অন্যদিকে গত বছর বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে ১৬ শতাংশ। পরিশোধ করা হয়েছে ২০১ কোটি ডলার। আগের অর্থবছর এটি ছিল ১৭৩ কোটি ডলারের কম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের আসল বেড়েছে ২৮ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় আসল পরিশোধের পরিমাণ ২২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছর এ পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আসল পরিশোধ বেড়েছে ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। সুদ এবং আসল মিলে গত অর্থবছরে মোট পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩৩৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার। আগের অর্থবছর যা ছিল ২৬৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৬৯ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় গত বছর সুদাসল বাবদ ৩৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আগের অর্থবছর যা ছিল ২৬ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানেই বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ ১০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
রির্জাভ থেকে ডলার বিক্রি:
বিলাসজাত পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতেও ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও ডলার সংকট মেটাতে বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে ১ হাজার ২৬৯ কোটি বা ১২.৬৯ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে কমে গেছে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ।
সংকটের কারণে ডলারের দামও বেড়ে গেছে। গত বছরের ১০ জুলাই যেখানে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হতো ১০৮ টাকা, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ১১৮ টাকা। যদিও এ দরে কেউ ডলার ক্রয় করতে পারছে না। ক্ষেত্রবিশেষ প্রতি ডলার পেতে ১২৩ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সার, জ্বালানি তেলসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার সহায়তা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিশোধ ঝুঁকি এড়াতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ফলে এটি রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।