মত-মতান্তর
গণমানুষের কবি আল মাহমুদ
শরীফ আস্-সাবের
(৪ সপ্তাহ আগে) ১৭ জুলাই ২০২২, রবিবার, ২:৩৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

কবি আল মাহমুদ
প্রায় নীরবেই চলে গেল বাংলাদেশের কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদের জন্মদিন। আজ থেকে ৮৬ বছর আগে ১৯৩৬ সালের ১১ই জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই জনপ্রিয় কবি।
আল মাহমুদ সর্ববাঙলার সাহিত্য জগতে এক নমস্য নাম। তাঁর ঘোর সমালোচকরাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এই ক্ষণজন্মা মানুষটির অনবদ্য অবদানের কথা। বন্ধুবর কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ভাষায়, 'সাহিত্যের বিচারে কবি আল মাহমুদ বাঙলা ভাষার একজন অবশ্যপাঠ্য কবিই শুধু নন, একটি সার্বভৌম অধ্যায়'।
তাঁকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। আমার পড়া মতে, রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী সময়ে আল মাহমুদের মতো শক্তিশালী লেখক বাংলা সহিত্যে বিরল। প্রেম, ভালোবাসা থেকে শুরু করে সমাজ, সংস্কৃতি এবং দ্রোহ সম্পর্কে সহজাত, সাদামাটা কায়দায় আল মাহমুদই বলতে পেরেছেন, “ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,/ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি” (সোনালি কাবিন) কিংবা “ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা/সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে কবিতা বোঝে না!” (অবুঝের সমীকরণ)।
জীবনের শেষভাগে ধর্মকে আলতো করে নিপুণ কুশলতায় কবিতায় টেনে এনেছেন আল মাহমুদ। তেমনি এক কবিতায় তিনি বলেন, “কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/ মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ/ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ' (স্মৃতির মেঘলাভোরে)। হঠাৎ ধর্মীয় অনুভূতি ও উপমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ায় অনেকেই তাঁকে অচ্ছুত জ্ঞান করেন। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে তাঁকে রাজাকার, আল বদর বলতেও পিছপা হন না। অথচ তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, অনেক নামী-দামি সাহিত্যিক যখন সরকারি পত্রিকার চাকুরী এবং ঢাকার মায়া ছাড়েননি, ভয় পেয়ে ছদ্মনামে লেখালেখি করেছেন, অকুতোভয় আল মাহমুদ তখন ইত্তেফাকের চাকুরী ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশান্তরী হয়েছেন।
যাই হোক, ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিশ্বাস অপরের ক্ষতি, ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষের কারণ সৃষ্টি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা আইন এবং সমাজের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। তবে, ধর্ম ও রাজনীতি দিয়ে সাহিত্যের বিচার না হলেও কেউ কেউ সাহিত্যকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক বিষবাষ্প ছড়ানোর বাহন হিসাবে ব্যবহার করেন যা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়।
রবিঠাকুরও ধর্মকে নিয়ে লিখেছেন এবং তাঁর বেশ কিছু লেখায় তিনি সরাসরি মুসলমান ও ইসলাম ধর্মকে টেনে এনে বিতর্কিত হয়েছেন। আর বঙ্কিম, ঈশ্বর গুপ্ত কিংবা শরৎচন্দ্রের কথা নাই বা বললাম। তবে ইঁনারা সবাই আমার প্রিয় লেখক। ইঁনাদের লেখালেখির সাহিত্য মূল্যকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ না থাকলেও তাঁরা কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। পাশাপাশি নজরুলও ধর্মীয় কবিতা, গান লিখেছেন। তবে তিনি ধর্ম বিদ্বেষী কিংবা ধর্মান্ধ ছিলেন না। একইভাবে, আল মাহমুদ সাধারণ মানুষের সহজ সরল ধর্মীয় বিশ্বাস এ মূল্যবোধকে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন। তবে, ধর্মকে অবলম্বন করে কবিতা লিখলেও আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় কোন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াননি। তথাপি, কি কারণে বা কোন যুক্তিতে আল মাহমুদকে নিয়ে কেউ কেউ অহেতুক নেতিবাচক প্রচারণা চালান, তা আমার ঠিক বোধগম্য নয়।
তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে তেমন একটা জড়িত না থাকলেও জীবনের শেষভাগে একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় কথা সাধারণ্যে চালু রয়েছে। সেই সুবাদে, অনেকেই তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। আমি মনে করি, নিজের মতো করে লেখালেখি কিংবা কোন রাজনৈতিক দলকে নীতিগতভাবে সমর্থন করা সকলের ব্যক্তি ও নাগরিক স্বাধীনতার অংশ। তিনি বেআইনি কিছু করেননি। তা’ছাড়া, তাঁর কখনো কোন প্রকার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কোন প্রমাণ নেই। আল মাহমুদ তাঁর একটি সাক্ষাতকারে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তিনি জামায়াতের সদস্য কোনকালেই ছিলেন না, তবে কবি হিসাবে এবং সংগ্রাম পত্রিকায় চাকুরী করার সুবাদে তাঁকে একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়েছে (রাজু আলাউদ্দীন, ‘কবি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার’ bdnews24.com, ২০০৮)। ঐ সকল অনুষ্ঠানেও তিনি কোন রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। বরঞ্চ তাঁর বক্তব্য সব সময়ই ছিল প্রগতিবাদী। উদাহরণস্বরূপ, এমনি এক অনুষ্ঠানে তিনি ইসলাম, কবিতা ও শাস্ত্র বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ‘কবিতাকে আপনারা ইসলাম দিয়ে বিচার করতে চাইলে ভুল করবেন। কবিতাকে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। শাস্ত্র চিরকাল নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় শিল্পের কাছে’ (জাকির তালুকদার, ‘আল মাহমুদ: গ্রহণ-বর্জনের দোলাচল’, ntvbd.com, ২০১৯)।
অর্থাৎ তাঁর কবিসত্ত্বা কখনো কোন রাজনৈতিক সত্ত্বার কাছে হার মানেনি। গণকন্ঠ সম্পাদক হয়েও তিনি যেমন জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়ান নি, সরকারী চাকুরী গ্রহণ করেও যেমন সরকারের তাবেদারী করেননি, তেমনি ভাবে তিনি সংগ্রাম পত্রিকায় চাকুরী করেও প্রত্যক্ষভাবে তাদের কোন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশ নেননি। তাঁর ভাষায়, ‘আই অ্যাম নট এ পলিটিশিয়ান… একবার বা দুইবার বা তিনবার তাদের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি তাতে আমাকে এভাবে চিহ্নিত করা ঠিক না’ (রাজু আলাউদ্দিন, ২০০৮, পূর্বোক্ত)। ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ মহলের অসাড় সমালোচনা যখন তুঙ্গে, অপর একটি সাক্ষাত্কারে নিরহঙ্কার, নিরভিমান আল মাহমুদ বলেন, ‘আমি ব্যক্তিমানুষ, আমার আচরণ, সামাজিক অবস্থান, সমর্থন এসব মানুষ হিসেবে আমার বিবেচনার ফল, সিদ্ধান্তের ফল। তাকে বিচার করার অধিকার অন্য কাউকে দেয়া হয় নাই। আমি চাই না কেউ আমার কবিতা পছন্দ করেন বলে আমার মতাদর্শ পছন্দ করবেন’ (শিমুল সালাহ্উদ্দিন, ‘আল মাহমুদ- এর সাক্ষাৎকার’, নকটার্ন ওয়েবম্যাগ, ২০১৫)।
সমস্যা তাহলে কোথায়? তিনি ইসলামকে বিষয়বস্তু করে কিছু কবিতা লিখেছেন। তাঁর নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তা তিনি লিখতেই পারেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী কিংবা অন্য কোন ধর্মের প্রতি অবমাননাকর কিছু তো কখনো লিখেননি বা বলেননি। একজন নির্ভেজাল, বিবেকাশ্রয়ী লেখক কি তা করতে পারেন? অথচ, তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর প্রতি বিশেষ মহলের আক্রোশ পডেনি। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কবিতা লিখে ফেরারী হওয়া কবির লাশ শহীদ মিনারে নিতে দেওয়া হয়নি; একজন প্রথিতযশা লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল সমাধি কিংবা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফনের অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
আসুন আমরা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সোজাসাপ্টা সব্যসাচী লেখককে ভুল না বুঝি এবং তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও ভালোবাসা দিয়ে তাঁর কীর্তি এ বিশালত্বকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। তাঁর আত্মা শান্তি পাক ওপার জগতে।
লেখক - ড. শরীফ আস্-সাবের, কবি ও প্রাবন্ধিক
পাঠকের মতামত
আল মাহমুদ কবি এবং কবি। তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব কোনকালেই খর্ব হবে না।
আমরা এমন এক জাতি, হারিয়ে ও বুঝতে পারলাম না কি হারিয়েছি।
আল মাহমুদকে নিয়ে এই ধরণের তথ্যবহুল লেখা আগে কখনো দেখিনি। আশা করি, এই লেখা কবির বাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অবস্খান নিয়ে বিভ্রান্তি ঘুচাবে। লেখক ড. শরীফকে ধন্যবাদ।
কবি আল মাহমুদ ছিলেন বাংলা সাহিত্য শিল্পের এক যাদুকরী পুরোহিত। সাধারণ সাহিত্য শিল্পকলার জাগরণে কবি আল মাহমুদ এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সাহিত্য চর্চার প্রাথমিক ধাপে বস্তুগত প্রগতিবাদকে প্রাধান্য দিলেও শেষ জীবনে এসে ইসলাম আর মুসলিম প্রগতিশীলতাকেও জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদানে রঞ্জিত করেছেন। জামায়াতে ইসলামী প্রকৃত ইসলামী সংস্কৃতি কৃষ্টিকে ধারণ এবং লালন করেন বলেই কবি আল মাহমুদের বিধৌত বিদগ্ধ সাহিত্য জ্ঞানের আলোয় ধরা পড়েছে। তাই ইসলামী সাহিত্য কলায় কবি আল মাহমুদের আত্মজ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটেছে। ললাটে রাজাকার আল বদরের তিলক রেখা কেউ কেউ অঙ্কনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। প্রমাণীত হয়েছে ইসলামকে ধারণ বরণ গ্রহণ করলেই রাজাকার আল বদরের ট্যাগ হজম করতে হয়।দেশ জাতি জনতার কাছে এবার লাউড এন্ড ক্লিয়ার জামায়াত কেন আলবদর এন্ড রাজাকার!
বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে আমার কেবলমাত্র আল মাহমুদ আর সৈয়দ হক ছাড়া বাকিদের মনে হয় যান্ত্রিক।
আমরা এমন এক জাতি, হারিয়ে ও বুঝতে পারলাম না কি হারিয়েছি।
গুণ আর গুণীজনে কদর নাই এখন। কদর আছে মাস্তান আর প্রভাবশালী ব্যক্তির যারা দুর্নীতিরা মাধ্যমে বিত্তশালী হয়ে প্রভাবশালী।
বিনম্র শ্রদ্ধা সোনালী কাবিনের কারিগরকে এবং সেই সাথে ড. শরীফ আস-সাবেরকেও।
After Kabi Nazrul, the most accepted poet of Bangladesh. May Allah rest his soul in peace.
Ami take akjon kobi hisebe dekhi, tar kobita valo lagto.