ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ

লঙ্কাকাণ্ডে প্রশ্ন, সংবিধানের জন্য জনগণ নাকি জনগণের জন্য সংবিধান?

তারিক চয়ন
১৭ জুলাই ২০২২, রবিবার
mzamin

এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেবল সংসদ সদস্যরা নন, দেশের প্রত্যেক নাগরিক ভোট দিয়ে থাকেন। ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে এত কম সময়ে এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব। সুতরাং, এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন। সুতরাং, এ ঘটনা থেকে এটাই স্পষ্ট যে, ‘সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণ সংবিধানের জন্য নয়’

সংবিধান হলো কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানকে এক কথায় শাসনব্যবস্থার মূল গ্রন্থ বলেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সংবিধান হচ্ছে দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। সংবিধান অনুযায়ী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। কিন্তু, প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে এমনও কিছু সময় আসে যখন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। যুগে যুগে জনগণের দাবির কাছে জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সংবিধানই অসার হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

গত ৩১শে মার্চ হাজারো বিক্ষোভকারী দেশটির সদ্য পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞাপন
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ১লা এপ্রিল প্রেসিডেন্ট দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ৩রা এপ্রিল গভীর রাতে শ্রীলঙ্কার মন্ত্রীদের প্রায় সবাই পদত্যাগ করেন। কিন্তু, বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী গোটাবাইয়া সরকারের সকলের পদত্যাগ দাবি করতেই থাকেন। সরকার তাদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালালেও তারা দমে যান নি। এমতাবস্থায় ৯ই মে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর হামলা চালায় সরকার-সমর্থকরা। বিক্ষোভকারীরাও পাল্টা হামলা চালান। ওই সংঘর্ষের জেরে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়ার ওপরও পদত্যাগের চাপ বাড়তে থাকে। কিন্তু, সেটা না করে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। ১২ই মে রণিল শপথ গ্রহণ করেন।

কিন্তু, আন্দোলন থেমে থেমে চলছিলই। রাজাপাকসে পরিবারের অত্যাচার আর দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ জনগণ দিন দিন আরও বেশি ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিলেন। এ পরিস্থিতিতে ৯ই জুলাই সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নাটকীয় মোড় নেয়। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়েন। তার আগেই অবশ্য প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছাড়েন গোটাবাইয়া। এরপর কয়েকদিন প্রেসিডেন্ট ঠিক কোথায় ছিলেন তা কেউই জানতো না। ১৩ই জুলাই প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়ার মালদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। ১৫ই জুলাই প্রেসিডেন্ট সিঙ্গাপুর থেকে ই-মেইলে স্পিকার বরাবর পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। একই দিন প্রধানমন্ত্রী ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু, এর মাঝের কয়েকদিন শ্রীলঙ্কা কীভাবে চলছিল তা নিয়ে সবাই যেনো মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

ওই কয়েকদিন শ্রীলঙ্কা সংবিধান অনুযায়ী চলছিল কিনা সেটা বুঝা যায় শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার এক সাক্ষাৎকার থেকে। ১১ই জুলাই দেয়া ওই সাক্ষাৎকারে সিরিসেনা বলেন,  ‘প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী এখনো পদত্যাগ করেননি, জনগণ ক্ষমতা দখল করেছে। এমন বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো মানে নেই। 

প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।’ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এবং বাসভবন দখলে নেয়ার পর তিনি (৯ই জুলাই) বিক্ষোভকারীদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন স্বীকার করে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের পরিবর্তন সংবিধান অনুযায়ী হয় নি, কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতি সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে ওইসব লোকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে বাধ্য করেছে ‘যারা’ অসাংবিধানিক  উপায়ে সরকারকে উৎখাত করেছে।’’ ‘যারা’ বলতে তিনি যে ওই বিক্ষুব্ধ জনতাকেই বুঝিয়েছেন এটা সহজেই অনুমেয়। এই ঘটনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট সংবিধানের উপরে দেশের জনগণের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হলেও সেটা দেশের মানুষের জন্যই রচিত।
শ্রীলঙ্কায় অনেক কিছুই যে এখন সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না সেটা বলাইবাহুল্য। আরেকটি ঘটনা থেকেও তা স্পষ্ট। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ৯ই মে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন। এর ফলে, দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু, কে হবেন নতুন প্রধানমন্ত্রী তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলো।

 এমতাবস্থায় সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন রণিল বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহেকেই শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে জানিয়ে দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার বুধবার (১৩ই জুলাই) বলেন, প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া তাকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে। সংবিধানের ৩৭ (১) ধারা অনুযায়ী এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

 কিন্তু, মুশকিল হলো রণিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি গোটাবাইয়া। পলাতক অবস্থায় তার সব ঘোষণাই হয় পার্লামেন্টের স্পিকার, না হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে আসছিল। তাছাড়া, শ্রীলঙ্কার বর্তমান পার্লামেন্টে নিজ দল ইউএনপি’র একমাত্র প্রতিনিধি কেবল রণিল বিক্রমাসিংহে। রণিলকে এভাবে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে আবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বানানোটা সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন খোদ সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী, সামাগি জন বালাবেগায়া দলের সাজিদ প্রেমাদাসা। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে রণিলকে নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেন, ‘এক আসনবিশিষ্ট একজন এমপিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। এখন সেই একই ব্যক্তিকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে...। প্রধানমন্ত্রী তখনই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হতে পারেন যখন প্রেসিডেন্ট তাকে এই পদে নিয়োগ করেন, অথবা প্রেসিডেন্ট পদটি শূন্য থাকে, অথবা যদি প্রধান বিচারপতি স্পিকারের সঙ্গে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রেসিডেন্ট নিজ দায়িত্ব পালমে অক্ষম। এসব কারণের যেকোনো একটি ছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন না এবং কারফিউ বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন না।’

লক্ষণীয় যে, সাজিদ প্রেমাদাসা কেবল রণিলের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে কিনা সে প্রশ্নই তুলেন নি, প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া পালিয়ে মালদ্বীপে চলে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে রণিল দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য যে জরুরি অবস্থা এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশজুড়ে যে কারফিউ জারি করেছিলেন তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল এবং বিশ্লেষকরাও বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিক্রমাসিংহে কারফিউ জারির এখতিয়ার রাখেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব না পেয়ে এ ধরনের আদেশ দিয়ে তিনি সংবিধানকে তোয়াক্কা করেন নি। কিন্তু, কিইবা করার ছিল বেচারা রণিলের! প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার তার কার্যালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে এগুচ্ছিল একদল বিক্ষোভকারী। এর আগে তার বাসভবনও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, পলাতক হলেও আইন অনুযায়ী গোটাবাইয়া রাজাপাকসে যেহেতু তখনো প্রেসিডেন্ট, তাই প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহে কোন ক্ষমতাবলে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেই প্রশ্ন রেখেছিল ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু। এর জবাবে তার মুখপাত্র দিনুক কলোম্বেজ বলেছিলেন, “এ বিষয়ে আইনি (সাংবিধানিক) ব্যাখ্যা আমরা পরে দেবো। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।”

এই ঘটনা থেকেও বুঝা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সংবিধানের উপরে দেশের জনগণের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশেষে, ১৫ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছিলেন গোটাবাইয়া। সংবিধানের ৩৭ (১) ধারা অনুযায়ী রণিল কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন উল্লেখ করে পার্লামেন্টের স্পিকার ইয়াপা আবেওয়ার্ডেনে জানিয়েছেন যে, ২০শে জুলাই শ্রীলঙ্কায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। কিন্তু, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেও কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে কিছুই জানাননি স্পিকার।

এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেবল সংসদ সদস্যরা নন, দেশের প্রত্যেক নাগরিক ভোট দিয়ে থাকেন। ২০শে জুলাইয়ের মধ্যে এত কম সময়ে এমন একটি নির্বাচনের আয়োজন করা কার্যত অসম্ভব। সুতরাং, এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন। সুতরাং, এ ঘটনা থেকে এটাই স্পষ্ট যে, ‘সংবিধান জনগণের জন্য, জনগণ সংবিধানের জন্য নয়’। সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণকে দমিয়ে রাখা যায় না। জনগণের প্রয়োজনে সংবিধানের মধ্য থেকেই সংবিধানকে সংশোধন করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সমঝোতা থাকলে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যেকোনো সময় সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকতে পারে না।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status