বাংলারজমিন
দুশ্চিন্তায় হাওর তীরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা
‘আফাল’ আর ‘বলনের’ ক্ষত দৃশ্যমান
ইমাদ উদ-দীন, মৌলভীবাজার থেকে
২৪ জুলাই ২০২৪, বুধবার
গেল কয়েকদিন থেকে হাকালুকি হাওর এলাকায় বানের পানি কমতে শুরু করায় জেগে উঠেছে ডুবন্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট আর ফসলি জমি। দৃশ্যমান হচ্ছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। এখন বন্যায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া হাওর তীরের অসহায় বাসিন্দারা নতুন করে সবকিছু গোছাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে এখন চরম অসহায়। ১৬ই জুন বন্যা শুরুর পর থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজেদের ঘরছাড়া হন হাওর এলাকার বন্যার্তরা। দীর্ঘদিন আশ্রয়কেন্দ্রেসহ অন্যত্র থাকার পর তারা নিজ বসতভিটায় ফিরলেও রয়েছে বিষাক্ত সাপ আতঙ্ক, আর আর্থিক অনটনের মধ্যে ঘরাবাড়ি মেরামতের দুশ্চিন্তা। জেলার কুলাউড়া, জুড়ী বড়লেখা এই ৩ উপজেলায় প্রায় দেড় মাস ধরে চলা রাক্ষুষী বন্যার তাণ্ডব কমতে শুরু করায় এখন অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে হাওরতীরের বাসিন্দারা। দীর্ঘ বন্যয় বড় ধরনের ক্ষতি এখন দৃশ্যমান হলেও বিদায় নিচ্ছে বিধ্বংসী আফাল আর বলন। এই অল্প কয়েকদিন হলো এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য পরিবর্তনের আফাল (বড় ঢেউ) বলনের (ঘূর্ণায়মান ঢেউ) তাণ্ডব এখন আর চোখে পড়ছে না হাওর এলাকায়। বাড়িঘর ভাঙার পর এখন অনেকটাই শান্ত আফাল আর বলন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে বানের পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এখন ততই কমছে। আর জেগে উঠছে ডুবন্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও কৃষিজমি। আর এতে দৃশমান হচ্ছে আফাল আর বলনের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি আর রাস্তাঘাট। এখন দৃশ্যামান এমন ক্ষতচিহ্নে দিশাহারা হাওরতীরের সর্বহারা কৃষি ও মৎস্যজীবী লোকজন। কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাট মেরামত করবেন- এমন দুশ্চিন্তা তাদের। এ বছর জুন থেকে শুরু হওয়া দু’দফা বন্যায় হাওর তীরবর্তী এলাকায় ছিল বানের পানিতে টইটুম্বুর। হঠাৎ এমন বন্যায় ঘরবাড়ি মৎস্য খামার আর সবজি ক্ষেত দখলে নেয় পানি। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আর হাটবাজারেও ছিল বানের পানির রাজত্ব। বন্যা দীর্ঘ হয়ে রূপ নেয় স্থায়ী জলাবদ্ধতায়। আর এতে প্রলয়ের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হাওরতীরের বসতভিটা আর রাস্তাঘাটে আঘাত হানে আফাল আর বলন। বন্যার জলাবদ্ধতা আর আফাল আর বলনে নিঃস্ব হাওরতীরের মানুষ। চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও মৎস্য খামার। এ বছর ফসল আর বসতভিটা কেড়ে নিয়েছে দু’দফা বন্যায়।
সরজমিন দেখা গেছে, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভুকশিমুইল, জায়ফরনগর, কালিমপুর ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম এলাকার বসতবাড়িতে এখন স্পষ্ট হয়েছে আফাল আর বলনের আঘাতের ক্ষতিচিহ্ন। ভুকশিমুইল ইউনিয়নের মীরশঙ্কর গ্রামের বাকির মিয়া ও জায়েদ মিয়া পেশায় তারা দুজনই মৎস্যজীবী। জানালেন বন্যা শুরুর পর থেকে আফাল আর বলনে তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। বন্যা শেষ হলেও তাদের বসতভিটা ও পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে পারছেন না। আর্থিক অনটন থাকায় ভেঙে চুরমার হওয়া ঘরবাড়িও মেরামত করতে পারছেন না। তাদের পরিবারের ৬-৭ জন সদস্য হলেও আয় রোজগারের মানুষ একজন। তাদের মতো অসহায় একই ইউনিয়নের সাদীপুর গৌরীসঙ্করসহ একাধিক গ্রাম। দৃশ্যমান এমন ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেকেই চেষ্টা করছেন। দেখা গেছে, অনেকেই নৌকাযোগে দূর থেকে মাটি এনে বসতভিটা ভরাট করছেন। আবার কেউ কেউ বসতভিটার বাঁশের বেড়া ও চালা মেরামত করছেন। তবে অধিকাংশ লোকজন আর্থিক অনটনের কারণে ভাঙা ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। তারা রাত পোহালে নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য এলাকায় গিয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন কিংবা মাছ ধরছেন। এই কায়িক শ্রমে যা পাচ্ছেন তা দিয়ে কোনোরকম টানাপড়েনের সংসার চালাচ্ছেন। ওই আয় থেকে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট টিউবওয়েব আর স্যানিটারি ল্যাটট্রিন মেরামতের সাধ্য কোথায়। হাওরতীরের অসহায় কর্মহীন এই কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষগুলো এখন আফাল আর বলনের ক্ষতি পোষাতে চরম অসহায়। রোপা আমন ধান চাষাবাদের সময় ঘনিয়ে আসছে। তারপরও এখনো কমছে না জলাবদ্ধতা। সবজি আর ধান চাষের অধিকাংশ জমিতে এখনো কোমর কিংবা হাঁটু পানি। তাই ব্যস্ত এই চাষিরা বলতে গেলে অলস সময় পার করছেন। হাতে টাকা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামতের এই সময়টুকু কাজে লাগাতে পারছেন না। সব মিলিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন হাওর পাড়ের লোকজন। রাস্তাঘাট আর ঘরবাড়ি জেগে ওঠায় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে হয়েছে তাদের। কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই এখনো নিরাপদ নয়। কারণ দীর্ঘ জলাবদ্ধতা, আফাল আর বলনে ব্যাপক ক্ষতিতে পড়েছে তাদের বসতভিটা আর রাস্তাঘাট। এগুলো মেরামতের সাধ্য নেই তাদের। কিন্তু তারপরও উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে নিজেদের ঘরবাড়িতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।