ঢাকা, ৯ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৩ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

অর্থনীতিতে নয়া ধাক্কা

এম এম মাসুদ
২৩ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার
mzamin

কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশ জুড়ে শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি, ইন্টারনেট বন্ধ আর সারা দেশে কারফিউ জারি থাকায় মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন। এতে ইন্টারনেটভিত্তিক লেনদেনে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। আবার কারফিউয়ের কারণে শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে দুর্ঘটনার শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা। ফলে গত বৃহস্পতিবার থেকে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ। রেমিট্যান্স আসার পথও বন্ধ। আমদানি পণ্য ছাড় করা যাচ্ছে না। বিদেশি অর্ডার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের কাস্টমস শুল্কায়ন কার্যক্রম। অন্যদিকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে গোটা ই-কমার্স খাত। বিক্ষোভের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া দ্রুতগতির ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ইন্টারনেটভিত্তিক মোবাইল আর্থিক সেবাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সবমিলিয়ে বড় ধরনের ধাক্কায় দেশের সার্বিক অর্থনীতি। 

এদিকে ব্যাংকাররা জানান, দেশের ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুরোপুরি ইন্টারনেটনির্ভর। আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ই-মেইলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে ই-মেইলে প্রয়োজনীয় নথিপত্রও পাঠাতে হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে নতুন কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশি ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশের ব্যাংকগুলোয় রেমিট্যান্স পাঠান। আন্তর্জাতিক লেনদেন সিস্টেম সুইফটের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের বার্তা বিটিআরসি গেটওয়ে হয়ে দেশে আসে। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সেসব বার্তা নিশ্চিত করা হলে তবেই ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্সের অর্থ জমা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট না থাকায় রেমিট্যান্স আসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আমদানি-রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়। রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে বিদেশি এক্সচেঞ্জগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করতে হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সেটা করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বাংলাদেশ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 
এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের রপ্তানির অর্ডার অন্য দেশে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার দাবি জানিয়েছেন তারা। 
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রেজোয়ানুল রহমান বলেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে ধস নেমেছে। রপ্তানি এখন হুমকির মুখে। রপ্তানির বাজার আগে থেকেই নিম্নমুখী ছিল। বর্তমান পরিস্থিতি আরও ঘি ঢেলে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, একদিন কারখানা বন্ধ থাকলে ১৬ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়, যা দেশীয় মুদ্রায় ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। মাসে গড়ে প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি  ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এদিকে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পণ্য জাহাজীকরণের তারিখ পার হয়ে গেলে তারা পণ্য নিতে চাইবেন না। পরে ক্রেতারা সেই পণ্যগুলো কম মূল্যে নিতে বাধ্য করেন। এতে ক্ষতির মুখে পড়বে পোশাক মালিকরা। এর চেয়ে বড় ক্ষতি হলো ক্রেতারা দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকলে তারা এদেশ থেকে রপ্তানির অর্ডার বিকল্প উৎস হিসেবে অন্য দেশে নিয়ে যাবেন। এর পরিণতি আরও ভয়াবহ। 
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্র জানায়, দেশের এই বন্দর দিয়ে সমুদ্রকেন্দ্রিক আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। ব্যাহত হচ্ছে শুল্কায়ন ব্যবস্থা। ইন্টারনেট সেবা বন্ধের আগে শুল্কায়ন হয়েছে এমন আমদানি ও রপ্তানির পণ্যই শুধু জাহাজীকরণ ও ডেলিভারি করা হচ্ছে। 
কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় গত বৃহস্পতিবার থেকে সার্ভার কাজ করছে না। ফলে বন্দর ও কাস্টমসে আমদানি ও রপ্তানি সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তা খুবই দুঃখজনক। এখন এটাকে থামানো উচিত। 
চলমান সহিংস ঘটনায় ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মগবাজারে ফল বিক্রি করেন আকুল আকন্দ। তিনি বাদামতলী থেকে ১৫ হাজার টাকার ফল এনেছিলেন। কিন্তু শাটডাউন ঘোষণার কারণে বেচাবিক্রি প্রায় বন্ধ। বিক্রি না হওয়ায় ফলগুলো পচে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। ফুটপাথের ব্যবসায়ীদের প্রায় একই অবস্থা। 
ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ থাকায় ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল সেবার অনলাইন লেনদেন বন্ধ রয়েছে। এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছে না গ্রাহকরা।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এসএমই উদ্যোক্তা সাজেদুর রহমান বলেন, ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। এরমধ্যে কয়েকদিন ধরে ইন্টারনেট নেই। এতে করে এসব ব্যবসায়ী আরও বহুমুখী সংকটে পড়েছে। সংকট দ্রুত দূরীকরণে সরকারের কাছে আহ্বান জানান তিনি। 
মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, মোবাইলে ইন্টারনেট না থাকায় লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। কারণ ম্যানুয়েল লেনদেন কিছুটা করা যাচ্ছে। অর্থাৎ এসব লেনদেন সিম নির্ভর। 
মালিবাগের একটি দোকানে মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে আসা খায়রুল হোসেন বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় মোবাইলে রিচার্জ করতে এসেছি। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে রিচার্জ করতে পেরেছি। পাশাপাশি গ্রামেও মায়ের কাছে কিছু টাকা পাঠিয়েছি। অর্থাৎ এসব লেনদেন হয়েছে সিমনির্ভর।
সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী এজেন্টরা। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় তারা ই-মানি সুবিধা নিতে পারছেন না। ফলে অনেক এজেন্ট ক্যাশ ইন সেবা দিতে পারছেন না। কাওরান বাজার এলাকার এজেন্ট ফয়সাল জানান, কেউ ক্যাশ আউট (নগদ অর্থ উত্তোলন) করতে চাইলে এতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু ই-মানি সুবিধা না পাওয়ায় ক্যাশ ইন (নগদ অর্থ পাঠানো) সুবিধা দিতে অসুবিধা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ক্যাশ ইন সুবিধা দেয়া প্রত্যেক এজেন্ট প্রতিদিন নির্ধারিত পরিমাণে ই-মানি সুবিধা নিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এ সেবা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। 
সেবাদাতা বিকাশ ও নগদ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় তাদের বিশাল পরিমাণ লেনদেন কমে গেছে। আগে যেটা ইন্টারনেট দিয়ে খুব দ্রুত লেনদেন হতো, এখন সেটা ম্যানুয়ালি হচ্ছে। এবং ম্যানুয়ালি লেনদেন বেশি বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে আর্থিক লেনদেন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। 
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status