ঢাকা, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

নিত্যপণ্যের বাজারের ঊর্ধ্বগতি ও কারসাজি থামাবে কে?

এসএম নাজের হোসাইন
১২ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার
mzamin

প্রতি বছর আমরা দেখে আসছি, ঈদের আগে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বাড়ে। একশ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীও এই পণ্যগুলোতে তাদের অর্থ লগ্নি করেন। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদুল আজহার অনেক আগে থেকে মসলা জাতীয় পণ্যের মজুত ও দাম বৃদ্ধি শুরু হয়। কিন্তু মজার কাহিনী হলো এবার পবিত্র ঈদুল আজহার পর থেকে বেশকিছু পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ, পিয়াজ ও চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করছে।
নিত্যপণ্যের অস্থিরতা এতটাই বাড়ছে যেখানে কাঁচা মরিচের ঝাল ও পিয়াজের ঝাঁজে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যেন ওষ্ঠাগত। ঈদে শুকনা মরিচের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি থাকে। আবার শুকনা মরিচের দাম বেশি থাকায় অনেকে কাঁচা মরিচে ভরসা করতেন। কিন্তু সেই এককেজি কাঁচা মরিচের দাম এখন ৩০০ টাকা ছুঁই ছুঁই, তখন তারা নিরুপায়। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ২৮০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পণ্যটির দাম ছিল ১৬০ থেকে ২০০ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দাম বেড়েছে।

ঠিক একইভাবে ঈদের আগে যে পণ্যটির দাম বেশি বাড়ে তা হলো পিয়াজ। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ঈদের পরে পিয়াজের দামে অস্থিরতা শুরু হয়। যদিও পুরো বছর জুড়ে এই পণ্যটির কারসাজি বছরের আলোচিত ঘটনার অন্যতম। পুরো বছর জুড়ে দফায় দফায় পিয়াজের দাম বাড়লেও সরকারের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ভারত থেকে পিয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু তারপরেও দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে।

প্রতিনিয়তই আমরা দেখছি, অতিসম্প্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। ফলে বাজারে এখন প্রতি কেজি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। পিয়াজের বাহার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতো। তার মধ্যে আগে দেশের বাজারে পিয়াজের দাম বাড়লে ভারত থেকে আমদানি করে বাজার মূল্য স্থিতিশীল করা হতো। কিন্তু এবার ভারতেও পিয়াজের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। দেশি মধ্যস্বত্বভোগী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদন কম, খরচ বেশিসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়ান। অন্যদিকে ভারত তার দেশে পিয়াজের উৎপাদন কম ও দেশীয় চাহিদা মেটানোর কথা বলে প্রথমে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে বাংলাদেশের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমদানির অনুমতি দিলেও তারা রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দেশে পিয়াজের বাজারে আরেক দফা আগুন দেবার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভোক্তা ও বাজার তদারকিতে যুক্তদের মতে পিয়াজের বাজারে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারসাজি ও হাতবদল বন্ধ হলে দাম নিয়ে নৈরাজ্য কিছুটা হলেও ঠেকানো যাবে। অন্যদিকে দেশীয় কৃষক অগ্রিম ও দাদন নিয়ে আগেই পণ্যটি বিক্রি করে দেন। এই প্রবণতা রোধে প্রকৃত কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা গেলে কিছুটা ফল পাওয়া যেতো। এ ছাড়াও কৃষক যাতে সরাসরি পণ্যটি বাজারজাত করতে পারেন সেজন্য কৃষকের হাট ব্যবস্থা প্রচলন করার সুপারিশ করা হলেও সেটি বেশিদূর আগায়নি। এখন কৃষক পণ্যটি বিক্রির জন্য ফড়িয়া ও দালাল এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তা নেয়ার কারণে তারা প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের মাঝে ঋণ আর কারিগরি সহায়তা পৌঁছাতে সরকার ইচ্ছা করলে ক্ষুদ্র ঋণদান কার্যক্রমে নিয়োজিত ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই)দের যুক্ত করতে পারেন।

এক্ষেত্রে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করতে পারেন।
খাদ্য নিরাপত্তায় চাল আমাদের অন্যতম উপসর্গ হলেও অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি এর দাম বাড়লেই সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। কোরবানির ঈদের পর ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং চালকলগুলো বন্ধ থাকায় প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। চাল ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো করপোরেট গ্রুপগুলো চালের বাজারে আসার পর থেকেই তারা বিপুল পরিমাণ ধান, চাল মজুত ও প্যাকেজিং করে চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়ায়। আমরা দেখি করপোরেট গ্রুপগুলো চালের প্যাকেজিং করে ৫ কেজির বস্তায় কেজি প্রতি ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার কৃষক পর্যায়ে ধান সংগ্রহ করে বিপুল মজুতের পাশাপাশি ধানের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ধান চাল সংগ্রহ ও মজুত কতোদিন এবং কতোটুকু রাখা যাবে সে বিষয়ে তদারকি নিশ্চিত করা গেলে এখাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিদেশ খেকে চাল আমদানি করে। কিন্তু সে আমদানিকৃত চাল কোথায় রাখছে এবং তা কোথায় বিতরণ করা হয় তার সুনির্দিষ্ট তদারকি না থাকায় প্রচুর আমদানির পরও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। 

বাজারে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন সবজির দাম কেজিতে ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তার মধ্যে বাজারভেদে বেগুন বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি। দিন দশেক আগেও এর দাম ছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কাকরোলের দাম ৩০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকা এবং করলা ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ২০ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়েছে বরবটি, টমেটো ও গাজরের। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার জন্য সাম্প্রতিক ভারী বৃষ্টি ও মৌসুমি বন্যার অজুহাত দিচ্ছেন। আবার অনেকে মৌসুম শেষ এবং শীতের মৌসুম আসার কথা বলছেন। এর বাইরে অতি প্রয়োজনীয় আলুর দাম বৃদ্ধিকে সামনে নিয়ে আসছেন। কিন্তু বন্যা তো সারা দেশে হয়নি।

সিলেট অঞ্চলের বন্যার কারণে সারা দেশে সবজির দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের উৎপাদিত সবজি দেশব্যাপী পরিবহনে তেমন কোনো সংকটও নেই। যদিও গত সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বগুড়ায় বাজার পরিদর্শনের সময় সবজির দাম দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘শায়েস্তা খাঁ’র আমলে সবজি বাজার।’ সত্যিকার অর্থে বগুড়ার বাজারে দাম অনেক কম হলেও ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে ভোক্তাদের অনেক বেশি দামে সবজি কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে। আর এর পেছনে মহল বিশেষের কারসাজি আছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিনিয়তই সবজি বাজারে হাত বদল ও মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের কারসাজির কথা আলোচনায় আসলেও সমাধানের চিত্র হতাশাজনক। যদিও পণ্য পরিবহনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চাঁদাবাজিকে সামনে আনলেও প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করা হয়।

সম্প্রতি আলুকাণ্ড নিয়ে কারসাজি সফল হবার পর দেখা যায়, এখন অনেক ব্যবসায়ী সবজিচাষিদের অগ্রিম দাদন নিয়ে পণ্য কিনে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে কৃষকের মাঠ থেকেও তারা পণ্যটি সরাসরি সংগ্রহ করছেন। ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তারা অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য হচ্ছেন। 
ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ায়। সরবরাহ ও যোগান ঠিক থাকলে পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে জিকির করেন। পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ থাকার পরেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি মানে যা খুশি তা করা নয়। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নিত্যপণ্যের বাজারের ওপর সরকারের যে তদারকি থাকার কথা, সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। রমজান ও ঈদের সময় সরকারের মন্ত্রী-আমলারা কিছুটা তৎপরতা বাড়ান। কিন্তু তারপরে সে তৎপরতা আর অব্যাহত থাকে না। বাজার তদারকিতে নিয়োজিত কাগজে-কলমে ১১টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও শুধুমাত্র ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। একটা সময় জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, র‌্যাব স্থানীয়ভাবে নকল, ভেজাল তৎপরতা রোধ ও বাজার তদারকিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। এখন তাদের আর সাধারণ মানুষের এই সমস্যা সমাধানে তৎপরতা নেই।

ফলে এই সুযোগে স্বার্থান্বেষী মহল তথা সিন্ডিকেট ইচ্ছেমতো প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা আশা প্রকাশ করেছেন, বছরের শেষ নাগাদ, নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল হবে এবং খাদ্যপণ্য মূল্যস্ফীতি কমবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা যেভাবে অপতৎপরতা চলমান রেখেছেন, সেখানে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, সাধারন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে করে মূল্যস্ফীতি কমার পরিবর্তে আরও বাড়বে।

মানুষ বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। এই কথাগুলো ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা বারংবার বলে আসলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয়কে সামনে এনে সমস্যাটিকে সমাধানের তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয় যে নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার অধিকার সুরক্ষায় বাজার তদারকি জোরদার, দেশে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের তৎপরতারোধ, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত করা, কৃষকদের সহজশর্তে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি টিসিবি, খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল-ভোজ্য তেলের মতো পণ্যগুলোর বিতরণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। তাহলেই সাধারণ মানুষের অতিপ্রয়োজনীয় জীবন জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি ও জীবনযাপনের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। 
লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। 
ই-মেইল: [email protected]

 

পাঠকের মতামত

থামানোর কেউ নেই। যারা কমাবে তারা দাম কমালে লাভের ভাগ থেকে বঞ্চিত হবে। বাজারে গেলে রীতিমত ভয়ে আঁতকে উঠি। শুধু মাত্র আল্লাহর অশেষ রহমতে জীবন চলে যাচ্ছে।

Ashiq
১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

"কোথাও কেউ নেই!"

Harun Rashid
১২ জুলাই ২০২৪, শুক্রবার, ১২:২২ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status