নির্বাচিত কলাম
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
প্রশ্নপত্র ফাঁস: পীরও যেন ধরা পড়ে
বদরুল হুদা সোহেল
২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার
আমাদের যাদের মেরুদণ্ড আছে, তারাও নির্বাক থাকি বা কলম ধরতে চাই না, পাছে আবার চৌদ্দ শিকের ভয় আছে কি-না এই ভেবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বরাবরই দায় এড়াতে চায়। তাদের দায় এড়ানোর দু’টি পোক্ত কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো, প্রতিষ্ঠান তাদের অদক্ষতার পরিচয় দিতে নারাজ। আর দ্বিতীয়টি অর্থসংক্রান্ত। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ক্ষেত্রে উক্ত মন্ত্রণালয় উপরোক্ত দু’টি কারণেই তাদের বক্তব্যের এহেন অবস্থান। তারা নিজেদের যেমন অদক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে চান না, তেমনি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা আয়োজনের প্রশ্ন আসলে কী পরিমাণ অর্থ আবারো লেগে যাবে তা ভাবা কষ্টের। তাদের বক্তব্যে যদি আশ্বাস থাকতো যে, তদন্তে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণিত হলে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে যেন কোনো পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাহলে অন্তত তাদের মেরুদণ্ডহীন বলতাম না। পরিহাসের বিষয় এই যে, এই প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা নিয়ে তদন্ত দূরের কথা, চলতি মাসের ২১ তারিখ তড়িঘড়ি করে তারা তৃতীয় ধাপের উত্তীর্ণদের ফলাফল প্রকাশ করে। এ নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় তুলকালাম
লোকমুখে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে জাগানো যায়, কিন্তু যে ঘুমের ভান করে থাকে তাকে জাগানো যায় না। আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও আজ এরকম। গত ২৯শে মার্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ (তিন পার্বত্য জেলা ব্যতীত) নিয়ে তৃতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এনিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার নানা হ্যান্ডেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের সকল মানুষ এই ঝড়ের কবলে পড়লেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের কাউকে এই ঝড় আঘাত হানতে পারেনি। বিষয়টি এমন যেন, সরকারের এই দপ্তরটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয়, ভিন্ন কোনো গ্রহে। আসল কথায় আসি, আমাদের দেশে পাবলিক পরীক্ষা বা সরকারি চাকরি নিয়োগ পরীক্ষায় অতীতে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার অনেক নজির রয়েছে। বেশ কয়েকবার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অনেক চুনোপুঁটি ধরা পড়েছে। খোদ সরকারি মুদ্রণালয়ের (বিজি প্রেস) মুদ্রণ শাখার কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতার ঘটনাও আবিষ্কার করেছে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। এবারো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের তৃতীয় ধাপের লিখিত পরীক্ষার দিনেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
এবার প্রশ্নপত্র ও ফলাফল সংক্রান্ত দায়িত্বে ছিল বুয়েট। আর সেই প্রশ্নপত্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফাঁস করে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে তা সমাধানের দায়িত্ব নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র। গোয়েন্দা- সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ এই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা হিসেবে জ্যোতির্ময় গাইন ও তার চাচা অসীম গাইন নামে দু’জনকে চিহ্নিত করেছে। এই অসীম গাইন পূর্ব থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস ও আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থেকে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে। এই জ্যোতির্ময় গাইন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও তার চাচা অসীম গাইন আদম ব্যবসায়ী। তারা তো এমনি এমনি প্রশ্নপত্র পেয়ে যায়নি। তাদের ওপরে ক্ষমতাশালী নিশ্চয়ই কেউ না কেউ রয়েছে। তারা যদি শিষ্য বা মুরিদ হয়, তাহলে তাদের অবশ্যই একজন পীর রয়েছে। আমার ধারণা, পীর ধরা পড়লে সব মুরিদ বের হয়ে আসবে।
এ লেখার শুরুতে যা বলতে চেয়েছিলাম, তা আরেকটু বিস্তারিত বলতে চাই। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের ওপর ন্যাস্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন কচি শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভিত গড়ে দিতে হয়। আর এই ভিত গড়ার মূল কারিগর হলেন, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক। শিক্ষক যদি ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পান, তাহলে তারা কেমন কারিগর হবেন, তা বোঝার বাকি নেই। আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের যখন মিডিয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তারা বরাবরের মতো একই উত্তর দেন; যাকে আমরা ‘সরকারি বক্তব্য’ বলি। বক্তব্যের ভাষা ছিল এরকম- “পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আর পরীক্ষার পর এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” কতোটুকু অবিবেচনাপ্রসূত ও অদক্ষতার পরিচয় এই বক্তব্যের মাঝে রয়েছে, তা বোধহয় ওই কর্মকর্তা ভেবে দেখেননি। এ ধরনের বক্তব্য আমরা যে প্রত্যাশা করি না, তা-ও নয়। কারণ, সরকারি কর্মকর্তাদের মানুষ হিসেবে যে মেরুদণ্ড থাকার কথা, তাদের অনেকেই যে এখন মেরুদণ্ড হারিয়েছেন, তার শুধু সচেতন মহল নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের লোকটিও জানেন। আর আমাদের যাদের মেরুদণ্ড আছে, তারাও নির্বাক থাকি বা কলম ধরতে চাই না, পাছে আবার চৌদ্দ শিকের ভয় আছে কি-না এই ভেবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বরাবরই দায় এড়াতে চায়। তাদের দায় এড়ানোর দু’টি পোক্ত কারণ রয়েছে।
প্রথমটি হলো, প্রতিষ্ঠান তাদের অদক্ষতার পরিচয় দিতে নারাজ। আর দ্বিতীয়টি অর্থসংক্রান্ত। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার ক্ষেত্রে উক্ত মন্ত্রণালয় উপরোউক্ত দু’টি কারণেই তাদের বক্তব্যের এহেন অবস্থান। তারা নিজেদের যেমন অদক্ষ হিসেবে প্রমাণ করতে চান না, তেমনি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা আয়োজনের প্রশ্ন আসলে কী পরিমাণ অর্থ আবারো লেগে যাবে তা ভাবা কষ্টের। তাদের বক্তব্যে যদি আশ্বাস থাকতো যে, তদন্তে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণিত হলে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা নেয়া হবে যেন কোনো পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তাহলে অন্তত তাদের মেরুদণ্ডহীন বলতাম না। পরিহাসের বিষয় এই যে, এই প্রশ্নবিদ্ধ পরীক্ষা নিয়ে তদন্ত দূরের কথা, চলতি মাসের ২১ তারিখ তড়িঘড়ি করে তারা তৃতীয় ধাপের উত্তীর্ণদের ফলাফল প্রকাশ করে। এ নিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় দফায় তুলকালাম। চারটি সেটে সন্নিবিষ্ট প্রশ্নপত্রের ‘মেঘনা’ ও ‘যমুনা’ সেট নিয়ে পরীক্ষা দেয়া পরীক্ষার্থীদের কারও ফলাফল উত্তীর্ণের তালিকায় আসেনি। সারাদিন কেটে যায়। রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফের সমালোচনা শুরু হলে কারিগরি ত্রুটির বাহানা দিয়ে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানের মধ্যরাতে আবার উত্তীর্ণদের বিশাল এক তালিকা প্রকাশ করে। যা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের উত্তীর্ণদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই। মোদ্দা কথা, পরীক্ষা পরিচালনা ও ফলাফল মূল্যায়ন উভয় ক্ষেত্রে তৃতীয় ধাপের প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিস্তর অনিয়মের যথেষ্ট কারণ রয়ে গেছে। যেহেতু প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ডিবি পুলিশের একটি বিশেষ টিম এখনো কাজ করছে, সেহেতু শেষ না দেখে তড়িঘড়ি করে মৌখিক পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করলে পরীক্ষার্থীদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করবে। যা পরবর্তীতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দিকে মোড় নিতে পারে। আমরা চাই, একটি সুষ্ঠু পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শুধু মেধাবীরাই শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত করুক। এর জন্যে প্রয়োজনে আবারো পরীক্ষার আয়োজন করা হোক। এটি কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগে ভবিষ্যত জাতি অসাড়তার দিকে যাক, এমনটি কারও কাম্য নয়। এরপরেও যদি কর্তৃপক্ষের টনক না নড়ে, তাহলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি কথাই শুধু বলবো- “ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে।”
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ।
পাঠকের মতামত
কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না স্যার।
যে সময়গুলোতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য শিক্ষিত, ভদ্র, নম্র মানুষগুলো শিক্ষকতা করেছিল, তাদেরই দ্বারা তৈরি শিক্ষিতরা যে যেখানে অন্যায়, অপকর্ম করার সুযোগ পাচ্ছে, তো তা করছে। সুতরাং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য ভালো শিক্ষক দরকার নয়।
সবকিছু কেমন যেন লেজে গোবরে অবস্থা।
একজন সুশিক্ষিত মানুষ।
অনবদ্য। সময়ের বাতায়ন খোলা লেখা। পুকুর চুরি, সাগর চুরি, সবই দেখতে দেখতে জাতি আজ হাপিত্যেশ। একটি দেশের দর্পণ হলো শিক্ষা সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত যারা জাতিকে শিক্ষা দিবেন সেই শিক্ষক নিগোগ পরিক্ষায়ও প্রশ্ন ফাঁস! তাহলে আমরা জাতি হিসেবে মেরুদণ্ড হীনতার কতটুকু অতল গহ্বরে নিপতিত হয়েছি! ঈশ্বরা, আপনারা ঐ গ্রামের বদ্র পল্লিতে আছেন।থাকুন। অনুগ্রহ পূর্বক জাতির মেরুদন্ড ধ্বংসের খেলা বন্ধ করুন।
দারুন লিখেছেন স্যার। ভগবান থাকেন ভদ্রপল্লিতে। বাহ