নির্বাচিত কলাম
বেহুদা প্যাঁচাল
নাটবল্টু, কটু কথা এবং গীতিকবির আকুতি
শামীমুল হক
৬ জুলাই ২০২২, বুধবারমাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এমন কিছু কি আছে যেখানে বিতর্ক নেই? অন্তত আমি খুঁজে পাই না। অবাক করা বিষয় হলো যতই বিতর্ক হউক, এ বিতর্কও মুহূর্তেই রূপ বদলায়। চরিত্র বদলায়। রাজধানীর লোকাল বাসগুলোই তার বড় প্রমাণ। কোনো স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে দেখা যায় সিট খালি নেই। আর যারা বসে আছেন সিটে তাদের কেউ কেউ চিৎকার করে উঠেন ওই উঠাইছস ক্যা? সিটিং ভাড়া নিবি আর দাঁড়াইয়া নিবি, এইটা হবে না। ভাড়া নিতে আয় লোকাল ভাড়া দিমু
আশাজাগানিয়া পদ্মা সেতু নিয়ে দেশজুড়ে উচ্ছ্বাস এখনও থামেনি। মানুষ ছুটছে পদ্মা সেতু একনজর দেখতে। এরই মধ্যে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যামেরাবন্দি হন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সেলফিতে। সঙ্গে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও রয়েছেন।
রাজধানী ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল চলাচল করবে। এমনটাই বলা হচ্ছে। আগামী বছর জুনকে টার্গেট করে রেলপথের কাজ এগিয়ে নেয়ার চিন্তা চলছে। এই একটি সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। অথচ যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা এই পদ্মা সেতু ইতিমধ্যে নানা কারণে আলোচনায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ভাইরাল বায়েজিদের নাটবল্টু খোলা আর গানের সঙ্গে এক মহিলার নাচ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াছড়ি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে নাটবল্টু খোলার ঘটনাটি। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা। নাটবল্টু খুলে টিকটক করে বায়েজিদ নামের এক যুবক। দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। বায়েজিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেয়া হয় রিমান্ডে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বায়েজিদকে নিয়ে দু’টি পক্ষ এখন মুখোমুখি। একপক্ষ বায়েজিদের পক্ষে বলছে। অন্যপক্ষ বিপক্ষে। কারও কারও প্রশ্ন বায়েজিদ এটা কেন করতে গেল? সে যদি পদ্মা সেতু দেখতেই যাবে তাহলে নাটবল্টুর দিকে তার নজর কেন? এটা কি পদ্মা সেতু দুর্বল এটা বুঝানোর জন্য? অন্যপক্ষ বলছে, নাটবল্টু পদ্মা সেতুর রেলিংয়ের। মূল সেতুর নয়।
পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যেই পরদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে কাজ করা শ্রমিকদের ইন্টারভিউ ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা মিডিয়াকে বলেছেন, আমরা এখনো কাজ শেষ করতে পারিনি। এসব নাটবল্টুতে ক্লিপ লাগানো হয়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জেনেছি, এসব নাটবল্টু অত্যাধুনিক। সাধারণ কোনো কাজে এসব ব্যবহার হয় না। পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত রেলিংয়ে ব্যবহৃত এসব নাটবল্টু গোটা বিশ্বে এভাবেই লাগানো হয়। ভূমিকম্পকে মাথায় রেখে এমনটা করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো- বায়েজিদ কেন এ কাজ করলো? তার উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য যদি খারাপ থাকে তাহলে অবশ্যই এর বিচার হওয়া উচিত। আর যদি না বুঝে করে থাকে তাহলে সতর্ক করে দেয়া দরকার। তবে কারোরই এমনটা করা উচিত নয়। এই স্থাপত্য দেশের সম্পদ। সবার দায়িত্ব একে রক্ষা করা। অন্যদিকে এর রূপ সৌন্দর্যের সঙ্গে নিজেকে সাক্ষী রাখতে দুই বাইকার সেলফি তুলতে গিয়ে জীবনটাই দিয়ে দিলেন। নিজ জীবন অবসানের মাধ্যমে মায়ের বুক খালি করে গেলেন তারা।
আনমনা হয়ে কাজ করতে গিয়েই জীবন প্রদীপ নিভে গেল তাদের। এরপর ওই রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি করে পদ্মা সেতুতে অনির্দিষ্টকালের জন্য মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। পরদিন সকালে এ নিয়ে আবার পদ্মাপাড়ে বাইকারদের ভিড়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে বাইকারদের যুক্তিতর্ক। একজন বলছেন, আমার ভাই মারা গেছে রাত একটায়। আমি ভোরে এখানে এসেছি। কিন্তু পার হতে পারছি না। হঠাৎ করে মোটরসাইকেল পারাপার বন্ধ করে দেয়ায় এমনটা হয়েছে। একদিন সময় দিয়ে করলে সবাই প্রস্তুতি নিয়ে আসতো। এরইমধ্যে দেখা গেছে, পিকআপভ্যান দিয়ে মোটরসাইকেল পদ্মা সেতু পারাপার করছে মোটরবাইক চালকরা। একেকটি পিকআপে ৫/৬টি করে মোটরসাইকেল পার করছে। এক বাইকার বলছেন, একজন মানুষসহ মোটরসাইকেল পার করেছি ৫০০ টাকা দিয়ে। কি করবো? কোনো উপায় নেই। অফিস ধরতে হবে।
পিকআপগুলো এ সুযোগে পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। বাইকারদের এমন দুর্দশার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে। এখন বাইক পার হচ্ছে ফেরি দিয়ে। বাইকে ঠাসা ফেরি চলছে পদ্মা ভেদ করে। এরই মধ্যে মঙ্গলবার ঘোষণা আসে পদ্মা সেতুতে স্পিড গান, সিসিটিভি বসিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা যে অনির্দিষ্টকালীন সিদ্ধান্ত, তা নয়। এটা এখন বন্ধ আছে, মোটরবাইক সম্পর্কে যেটা বলা হয়েছে, সেখানে এখন স্পিড গান, সিসিটিভি মিটার বসানো হবে। সেগুলো সেট আপের পর হয়তো নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, পদ্মা সেতুর কারণে ফেরি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। চাহিদা অনুযায়ী ফেরি চলাচল করবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ স্থাপনা পদ্মা সেতু। তার মানে এই নয়, আমাদের অন্যান্য যোগাযোগ বন্ধ হবে। শিমুলিয়া, মাঝিঘাট দিয়ে ফেরি চলাচল করেছে। আমরা ফেরি বন্ধ করে দেইনি, সেখানে ৬টি ফেরি চাহিদা অনুযায়ী পারাপার করছে।
আমরা সময় নিচ্ছি, পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের আবেগ অনেকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। পজেটিভ-নেগেটিভ অনেক অনুভূতি রয়েছে। যাত্রী কম থাকায় লঞ্চ মালিকদের হতাশা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিন দিনেই হতাশা এলে হবে না। আমরা তো আশাবাদী। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কেন তৈরি করছি? এটার চাহিদা আছে বলেই করছি। সেজন্য আমাদের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, আমরা তো লক্ষ্য নিয়েই আছি। পদ্মা সেতুর নাটবল্টু খোলার সঙ্গে রাজনীতি দেখছেন কিনা- এ প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি একজন নেত্রী যিনি এতিমের টাকা আত্মসাতের জন্য কারাবরণ করছেন। তিনি নিজেই বলেছেন পদ্মা সেতুতে কেউ যাবেন না, ভেঙে পড়বে, এটার নাটবল্টু জোড়াতালির। তার যারা ফলোয়ার আছে, তারা তো এটাকে সত্যই মনে করবেন। মন্ত্রীর এ কথায় বিতর্ক জুড়ে দেয়া হলো। দেশের রাজনীতিতে বিতর্ক তৈরি করা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, এমন কিছু কি আছে যেখানে বিতর্ক নেই? অন্তত আমি খুঁজে পাই না।
অবাক করা বিষয় হলো যতই বিতর্ক হউক, এ বিতর্কও মুহূর্তেই রূপ বদলায়। চরিত্র বদলায়। রাজধানীর লোকাল বাসগুলোই তার বড় প্রমাণ। কোনো স্ট্যান্ড থেকে বাসে উঠলে দেখা যায় সিট খালি নেই। আর যারা বসে আছেন সিটে তাদের কেউ কেউ চিৎকার করে উঠেন ওই উঠাইছস ক্যা? সিটিং ভাড়া নিবি আর দাঁড়াইয়া নিবি, এইটা হবে না। ভাড়া নিতে আয় লোকাল ভাড়া দিমু। দাঁড়ানোদের মধ্যে কেউ কেউ উল্টো চিৎকার দেয় আধাঘণ্টা ধরে খাড়াইয়া রইছি। একটা গাড়িতে উঠতে পারি না। ভাড়া কি কম দিমু? কিন্তু আরেকদিন দেখুন বসে যাওয়া লোকটিকে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে যাওয়া লোকটি বসে যাচ্ছে। এরই সঙ্গে তাদের মুখের ভাষাও উল্টে গেছে। আসলে অবস্থানের কারণেই বিতর্কের রূপ বদলে যায়। এক সময় জাতীয় সংসদের বিতর্ক দেখতে টিভি খুলে বসে থাকতো দেশের মানুষ। বিতর্ক দেখাই ছিল এর মূল কারণ।
ট্রেজারি বেঞ্চ থেকে একরকম কথা, আবার বিরোধী দল থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি এক রসাত্মক হয়ে উঠতো মানুষের কাছে। তাই সবাই সংসদ চলাকালে টিভি খুলে এসব দেখতো। স্কুল-কলেজগুলোর বিতর্ক অনুষ্ঠানেও দেখা যায় দু’পক্ষই বিষয়বস্তুর পক্ষে-বিপক্ষে ঝড় তুলছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেদের বক্তব্যকে বাস্তব প্রমাণ করাতে। কিন্তু অন্য কোনো বিতর্ক অনুষ্ঠানে এ দলই যদি অবস্থান বদল করে বসে তাহলে তাদের সুরও পাল্টে যায়। আগের বিতর্ক অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য সমর্থন দিতে পারেনি এখানে সে বক্তব্যকে সমর্থনই দিচ্ছে না শুধু তাদের বক্তব্য যে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণ করতে নানা উদাহরণ তুলে ধরছে। সমাজের সর্বত্র আজ বিভক্তি। এ বিভক্তি শুধু স্বার্থের। স্বার্থের জন্যই একটি বিষয়ে একেক অবস্থানে একেক বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। ওদিকে গীতিকবির আকুতি-রজনী হইসনা অবসান/ আজ নিশিতে আসতে পারে/ বন্ধু কালাচাঁন। গানে গানে এমন আকুতি কি শুনেছিল রজনী? না। রজনীর পর রজনীর অবসান হচ্ছে।
থেমে থাকছে না। অথচ কিছু কিছু মুহূর্ত যেন শেষ না হয়- এমন চাওয়া থাকে হৃদয়ে। হৃদয়ের এ চাওয়া কি পূরণ হয়? আসলে মানুষের চাওয়ায় কি আসে যায়? স্টিয়ারিং যদি অন্যের হাতে থাকে তাহলে কারও কিছু করার থাকে না। এখানেই অসহায় সবাই। তবে ওইসব মুহূর্ত স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে মানুষ। ক্যামেরা কিংবা ভিডিওতে ধারণ করে রাখে। কখনো সেই মুহূর্তের কথা মনে হলে যত্নে রাখা ছবি কিংবা ভিডিও বের করে দেখে। আফসোস করে। অতীতের কথা মনে করে নস্টালজিয়ায় ভুগে। কখনো কখনো চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে জল। সত্যিই মানুষ কতো কিছুই না চায়। ভাবে, এটা যদি এভাবে হতো। ওটা যদি সেভাবে হতো। সেটাতো আর হয় না। কীভাবেই বা হবে? পথহারা পথিক পথ ফিরে পেতেও পারে। আবার কখনো পথ ফিরে নাও পেতে পারে। একবার পথ হারালে আবার পথে ওঠা যে কতো কঠিন যারা পথ হারিয়েছে শুধুমাত্র তারাই জানেন।
তাই পথে উঠলে সবসময় মনে রাখতে হয়, পথ যেন না হারাতে হয়। এটা মনে থাকলেই সঠিক পথে চলা যায়। আর বেপরোয়া গতিতে চললে পথ থেকে ছিটকে পড়তে হয়। ঘটে দুর্ঘটনা। কখনো কখনো নদীতে তলিয়ে যেতে হয়। সেখান থেকে ওঠার আর কোনো উপায় থাকে না। পৃথিবীতে কতো উত্থান-পতন হয়েছে। ইতিহাসের পাতা ভারী হয়েছে। পাল, সেন, মুঘল, নবাব আমলের বিলুপ্তি ঘটেছে বহু আগে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আজও জ্বল জ্বল করে সেসব দিনের স্মৃতি। কথায় আছে-আকাশে তাকিয়ে পথ চললে হোঁচট খেতে হবেই। তাই মাটির দিকে তাকিয়ে পথ চলা সবার জন্য ভালো। এই ভালোটাই আমরা বুঝতে শিখিনি। আর শিখিনি বলেই উল্টোটা করি। আমরা যা করি তাকে ঠিক বলে মনে করি। কেউ যদি বেঠিক বলে শুধরে দিতে চায় তাকে কটু কথা বলি।