ঈদ সংখ্যা ২০২৪
দেশের বাইরে প্রথম
আইরিন আঁচল
(৯ মাস আগে) ১৩ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৪:২৫ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:৫০ অপরাহ্ন
‘বাঙালি মায়েদের সাধারণ একটা কথা- বিয়ের পর বরের সঙ্গে ঘুরতে যাইও’। বরের সঙ্গেই দেশের নানাপ্রান্তে ঘুরেছি। দেশের জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলো প্রায় ঘোরা শেষ। ২০২৩ সালে পাশের দেশ ভারতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট। আমি ক্রিকেট দেখি কিন্তু সরকারের ক্রিকেট ভীষণ প্রিয়। আচ্ছা সরকার আমার স্বামীর নাম, পুরো নাম পিয়াস সরকার। পরিকল্পনা করলাম কলকাতা যাবো বাংলাদেশের খেলা দেখতে। কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেনে খেলবে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডস। কিন্তু ভিসার আবেদন করতে দেরি হওয়ায় দেখা হলো না খেলা। বাংলাদেশ এ ম্যাচটায় হেরেছিল। এত কষ্ট করে গিয়ে বাংলাদেশের হার দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগতো না। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গেলাম কলকাতা। প্রথম দেশের বাইরে পা দেয়া। যদিও সরকারের দেশের বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আগেই হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের যাত্রা শুরু। এই যাত্রার আগে কয়েকদিন ধরেই এক্সসাইটমেন্ট ছিল তুঙ্গে। রাতে বাস। তড়িঘড়ি অফিস শেষ করে রওয়ানা দিলাম বাড়িতে। ব্যাগ গোছানোই ছিল। ধরলাম রাত সাড়ে ১০টার বাস। প্রথমে যাবো বেনাপোল। নির্ধারিত সময়েই বাস ছাড়লো। আধাঘণ্টা পর পৌঁছালাম সায়েদাবাদ। বাসের সুপারভাইজার একবার সতর্ক করে দিয়ে গেলেন কেউ জানালা খোলা রেখে মোবাইল চালাবেন না। কথাটা শুনে জানালা লাগিয়ে দিলাম। এরপর হাতে মোবাইল নিয়ে চালাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার পেছনের সিটের জানালা যে খোলা তা খেয়ালই করিনি। হঠাৎ একটা হাতের ছোঁ। চিৎকার করে উঠলাম, হাতে একটু ব্যথাও পেয়েছিলাম। দু’হাতে মোবাইলটা ধরে রাখায় নিতে পারেনি। ট্যুরের সকল উচ্ছ্বাস যেন এক মুহূর্তে পরিণত হলো ভীতিতে। এই ভীতিতেই কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা।
রাত ৩টার দিকে পৌঁছালাম বেনাপোল। ভয় যে একটা পেয়েছিলাম সেটা আবার বেড়ে গেল। কাউন্টার থেকে বলা হলো এত রাতে রাস্তার দিকে যাবেন না। বিপদ হতে পারে। যদিও অনেকেই শুনলেন না। কিন্তু একবার বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় রিক্স নিলাম না। কাউন্টারেই বসে রইলাম এক ঘণ্টা। তখন সময় সাড়ে চারটা। আমাদের সকল কাগজপত্র রেডি, ট্যাক্স সবই দেয়া ছিল আগেই। আসলে কাউন্টার থেকে ভয় দেখিয়ে ব্যবসা করতে চেয়েছিল। যাদের ট্র্যাভেল ট্যাক্স, পোর্ট ট্যাক্স দেয়া নাই তারা যাতে কাউন্টারের মাধ্যমে দেয়। এটা বোঝার পরও ভয় যাচ্ছিলো না। যাক আরেকটা বাসের যাত্রীদের সঙ্গে এগুলাম ইমিগ্রেশন লাইনের দিকে। সাড়ে ৬টায় শুরু হবে ইমিগ্রেশন কিন্তু সাড়ে চারটায় লাইনে দাঁড়িয়ে আফসোস করলাম কেন আরও আগে লাইনে দাঁড়ালাম না। আমাদের সামনে তখন প্রায় ৫০-৬০ জন দাঁড়িয়ে। বোরিং সময় পার করে সাড়ে ছয়টার দিকে ঢুকলাম ইমিগ্রেশনে। যাক ঘণ্টা দুয়েক লাগলো সব প্রসেস শেষ করতে। প্রথমবার দেশের বাইরে রাখলাম পা। অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। ওপারে পা রাখতেই বদলে গেল ভাষা, কথার ধরন। যদিও আশেপাশে সবকিছু বাংলাদেশের মতোই। কিন্তু অনুভূতিটা ছিল- ইয়েস আমি এখন দেশের বাইরে, আমি এখন বিদেশি। কলকাতা ট্যুরে অনেক কিছুই মনে ধরেছে। অন্যতম প্রধান ভালোলাগা ছিল ট্রেন ও খাবার। অটো ধরে এলাম বনগাঁও রেলস্টেশনে। প্রথমবার স্বাদ নিলাম বিদেশে খেতে কেমন লাগে। ভাতের সঙ্গে মাছ ও সবজি। বনগাঁও থেকে দমদম ৭০ কিলোমিটার রাস্তা। ট্রেনের টিকিট করলাম। ট্রেনের সময় ১০টা ২৮ মি.। আর ভাড়া শুনে চমকে গেলাম। ৭০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র ১৫ রুপি ভাড়া! টাকায় প্রায় ২১ টাকা মাত্র। আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন ট্রেনটা ঠিক সময়েই ছাড়লো। এক মিনিটও দেরি করলো না। মেনে নিতে পারছিলাম না। একটা লোকাল ট্রেন কীভাবে ঠিক সময়ে ছাড়ে। স্টেশনটা বেশ পরিষ্কার। দু’ঘণ্টার যাত্রা। শুরুতে ট্রেন ফাঁকাই ছিল। কয়েকটা স্টেশন যাবার পর উপচে পড়া ভিড়।
পশ্চিম বাংলার ভাষাটা বেশ উপভোগ করলাম। ভিড়ের কারণে ঠিকমতো বসাও যাচ্ছিলো না। ট্রেনে একটা অফিসগামী দলের সঙ্গে কথা হলো। তারা প্রতিদিন এই ট্রেনে একই বগিতে অফিস যান। পরিচিত হলাম আমরা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বেশ খাতিরও করলেন তারা। মৃদুল নামে এক দাদার সঙ্গে কথা হলো। তার দাদা বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তার বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় বছরে একবার করে যেতেন। তার জন্ম ভারতে। কিন্তু শৈশবের চার বছর কেটেছে কুষ্টিয়ায়। তিনি বললেন, ইলিশ দাও না কেন তোমরা? ওরে বাবা যা দাম- একবার উল্টিয়ে দেখলেই ৫০০ টাকা বেড়ে যায়। তিনি একটি করপোরেট অফিসে প্রধান নিরাপত্তাকর্মী। তিনি প্রতিদিন ৮৬ কিলোমিটার ট্রেনে ও মেট্রোতে যাতায়াত করে অফিস করেন। শুনে বেশ অবাকই লাগলো। এটা হয়তো বাংলাদেশে সম্ভব না। কারণ সেখানেই ১০টা ২৮’র ট্রেন ১০টা ২৮’এই আসে আর আমাদের দেশে...। দমদমে নেমে এবার উঠলাম মেট্রোতে।
৯.৮ কিলোমিটার রাস্তায় ভাড়া লাগলো মাত্র ১৫ রুপি। যেখানে বাংলাদেশে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের ভাড়াই গুনতে হয় ২০ টাকা। তবে মেট্রোর ভিড়টা বাংলাদেশের মতোই। মেট্রো ছাড়তেই ঢুকে গেল মাটির নিচে। প্রথম পাতাল ট্রেনের অভিজ্ঞতাটাও নেয়া হয়ে গেল। এরপর দীর্ঘ ক্লান্তিকর পথ পাড়ি দিয়ে নামলাম এসপ্লানেট স্টেশনে। আগেই হোটেল ঠিক করা ছিল। কলকাতায় আমরা ছিলাম পাঁচদিন। ক’টাদিন কলকাতাতেই ছিলাম। আগেই টার্গেট ছিল প্রচুর স্ট্রিট ফুড খাবো। তালিকাও করে গিয়েছিলাম। আমরা ছিলাম সদর স্ট্রিটে। এই নিউ মার্কেট এলাকাটা বাংলাদেশিদের জন্য জনপ্রিয়। পরের দিন সকালে উঠে গেলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও হাওড়া ব্রিজ। একদম নতুন পরিবেশ। নতুন অভিজ্ঞতা। প্রত্যেকটি স্থানই বেশ উপভোগ করেছি। সময় কেটেছে দারুণ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরট এত সুন্দর। এত বছরের পুরনো নির্মাণ কীভাবে সংরক্ষণ করছে তারা, না গেলে বুঝতামই না! হাওড়া ব্রিজ পার হলাম হেঁটে। নিচে নদী। উপরে ঝুলন্ত ব্রিজ। আর সেখান দিয়ে হাঁটছি আমরা। এত ভালো লেগেছে মুহূর্তটা! ঐতিহাসিক কফি হাউজের কফিটার স্বাদও নিলাম। হাতে টানা রিকশা, আর ঘটর ঘটর করে চলা ট্রামের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। কলকাতায় আমরা অমর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটা ছিলাম। অনেক স্থানেই দেখা মিললো ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে। এত ভালো লেগেছে দৃশ্যগুলো অসাধারণ। আর কফি হাউজ যাবার পথে একটা পুকুর ঘাট পেলাম। নামটা মনে পড়ছে না। সেখানে দেখলাম মেয়েরা সুইমিং কস্টিউমস পরে ড্রাইভ করছে। সাঁতারের বিভিন্ন খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওপেন স্পেসে মেয়েরা সুইমিং কস্টিউমস পরে পানিতে লাফাচ্ছে এটা ভাবতেও ভয় করে। কিন্তু তারা সাবলীল, অসাধারণ। পাশেই অভিভাবকরা বসে দেখছেন মেয়েদের শারীরিক কসরত।
কলকাতায় মন ভরে খেয়েছি গরুর মাংস আর কাচ্চি। এক প্লেট গরুর মাংস মাত্র ৫০ রুপি। কাচ্চির কথা কী বলবো ৭০ রুপি প্লেট। বাসমতী চাল, বড় বড় দু’পিস গরুর মাংস। এই কাচ্চি বাংলাদেশে খেলে লাগতো ২৫০/৩০০ টাকা। স্বাদ নিলাম ডাল মাখন, লেমন সোডা, পাও ভাজি, ফ্রুট চাট, পাপড়ি চাট আরও কতো কি। এভাবে ৩ দিন পেরিয়ে গেল। চতুর্থ দিন কেনাকাটার পালা। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ব্যাগ খুব বেশি ভারী করবো না। ২/১টি জিনিস কিনবো। তারপর টুকটাক কেনাকাটা করতে করতে কখন যে বিশাল এক্সট্রা ব্যাগ হয়ে গেল খেয়ালই করিনি। এক বিখ্যাত জুতার দোকানে শুধু ঢুঁ মারতে গিয়েছিলাম। ঢুঁ মারতে গিয়েই চলে গেল সাড়ে ছয় হাজার রুপি। আর সকল পণ্যের দামই সস্তা। এবার আসার পালা। ভাবলাম এত বড় ব্যাগ নিয়ে আর ভেঙে যাবো না। কলকাতা-ঢাকা সরাসরি বাসেই রওনা করি। সেভাবেই রওনা করলাম। ২৩ তারিখ দুপুর আড়াইটায় বর্ডার পার হয়ে চলে আসলাম নিজের দেশে। আমার ডায়েরিতে স্থান হলো বিদেশ ভ্রমণের নতুন স্মৃতি। যে স্মৃতিটা আমাকে আনন্দ দেয়। যার জন্য অপেক্ষা ছিল দীর্ঘদিনের। আর আসার সময় ৫০ রুপি কেজিতে মিললো আঙ্গুর। নিয়ে নিলাম দুই কেজি। এত সস্তায় ফলতো আর দেশে মেলে না।
দারুণ লেখা!