ঈদ সংখ্যা ২০২৪
শ্রেণিশত্রুর দপ্তর
অপু শহীদ
(৮ মাস আগে) ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৩:৫৫ অপরাহ্ন
সচিত্রকরণ: মৃত্তিকা সুমন শ্রেয়া
কথাগুলো শুরু হওয়া দরকার। ঢের দেরি হয়ে গেছে। বাগানের একপাশ দিয়ে একখানা চাঁদের চিওলি দেখা যায়। মাঝে মাঝে বড়ো হয়। আবার সরু চিকন। মেঘের খেলা। ঠান্ডা হাওয়ায় বেলকনির অপরাজিতা শিরশির করে কাঁপে। কোথাও না কোথাও আজও সাপেরা চলাচল করে। মনসামঙ্গল হাঁটু বেয়ে উঠে মগজে উঁকি দিবেই।
কথাগুলো বলে ফেলা দরকার। রাস্তায় খুব জ্যাম। শুধু শব্দ আর শব্দ। কেউ কারও কথা শুনছে না। সকলেই বলছে। কে কার কথা শুনবে। শব্দ একটার মধ্যে আরেকটা ঢুকে যাচ্ছে। বাক্য তৈরি হচ্ছে না। আংশিক কথা সিগন্যালে আটকে যায়। আংশিক লালবাতির ভেতর দিয়েই উড়ে যায়। শব্দজট শুধু ছুটতে থাকে।
কথাগুলো কেউ বলছে না। রমেশ স্যারের তোশকের নিচে নানা রঙের স্যান্ডেলের ফিতা থাকতো। লাল, সবুজ, কালো। চুল বাঁধার রবার, ফিতা, পিন, সেপটিপিন এসব দ্রব্যাদি। আর থাকতো সুতলি, তার, তারকাঁটা, বোতাম, হুক। মুকুল তোশক তুলে আমাদের দেখাতো কোনটা ব্রা’র হুক আর কোনটা ব্লাউজের হুক। রমেশ স্যার বিয়ে করেনি। কৌটা ভরা কিসমিস রাখতো। টসটসা হলুদ কিসমিস। কিন্তু সেসব কথাতো কেউ মনে রাখেনি। বাবু অনেক বছর পর আমেরিকা থেকে এসেছে। বাবুসহ কয়েকজন আমাদের স্কুল দেখতে গেলাম। বাবু অবাক হয়ে বললো সবকিছু এত ছোট হলো কী করে। ক্লাসরুম এতটুকু ছিল? একথা ওকথায় লোকমান স্যারের কথা উঠলো। তোহা স্যারের কথা উঠলো। রমেশ স্যারের কথা উঠলো। বাবু রমেশ স্যারকে মনেই করতে পারলো না। কেবল ভাসা ভাসা বড়ো একটা মুখ আবছাভাবে মনে আসছে। আর কিছু মনে করতে পারলো না।
সকলে বেমালুম সবকিছু ভুলে যায়। কেউ কেউ বলছে করোনা মহামারির প্রভাব। কেউ বলে হাজার বছর ধরেই আমরা পুষ্টিহীন। সেই মোগল-পাঠান কোথা কোথা থেকে এসে আমাদের ওপর চাবুক চালালো। দুশো বছর ধরে ইংরেজ চাকর করে রাখলো। তারপর তেইশ বছর পদানত থেকে আমরা লাঠিসোঠা হাতে নিলাম। আবার কারও মতে জাতি হিসেবে আমরা বিস্মৃত জাতি। নদীভাঙনে সব হারিয়ে যায় বলে কেউ কিছু মনে রাখে না। তবে নদী একদিন সব ফিরিয়ে দেয়। মানুষের স্মৃতিও সময়ের প্রয়োজনে ভেসে ওঠে। যা জন্ম নেয় তা একদিন মরে যায়। আর যা মরে যায় তা আবার জন্ম নেয়।
আমার বড়ো মামার নাম ছিল বেলায়েত হোসেন। মা-মামারা ছয় ভাই-বোন ছিল। বেলায়েত মামা বাদে সবাই জীবিত। বড়ো মামাকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের আগেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু হয় মানে তাকে মেরে ফেলা হয়। সে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। মামা নারিন্দা থেকে টিপু সুলতান রোড দিয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলো জিন্নাহ এভিনিউর দিকে। গ্রাজুয়েট স্কুলের কাছে আসতেই পুলিশ গুলি করে। সে পুলিশ বাঙালি না বিহারি কেউ বলতে পারেনি। গুলি ভেদ করে যায় চোখ বরাবর। এসব আমি ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছি। বাবা একই মিছিলে ছিল। মামা আর বাবা ছিল বন্ধু।
গুলির পর কেউ বনগ্রামের দিকে কেউ ধোলাইখালের দিকে পালিয়ে যায়। বাবা আর কয়েকজন মিলে বেলায়েত মামাকে কাঁধে করে এলাকায় নিয়ে আসে। স্কুল ঘরের কোনায় ছিল কলপাড়। কলপাড়ে এসে সবাই রক্ত ধুয়ে ফেলে। মামা মারা যায়। স্বামীজি বাড়ির পাশে মহল্লার কবরস্থানে মামার দাফন হয়। এসব ছিল ৭ই মার্চের তিনদিন আগের ঘটনা। এর কয়েকমাস পর মহল্লার দুই ওস্তাগার ওসমান আর সোবহান কলপাড়ের কোনায় একটা মিনার বানায়।
মিনারের উপরের অংশ চৌকোনা। তাতে দুটো চোখ। চোখদুটো প্রায় দুই ফিট খোড়ল। একপাশ দিয়ে তাকালে আরেক দিক দেখা যায়। অর্থাৎ দুপাশেই চোখ। চোখের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে কথা বললে অপরদিক দিয়ে গম্ভীর আবৃত্তির মতো শোনায়। আমরা একপাশ থেকে বলতাম- বুলবুলি তোর হোগা কেন লাল, আল্লা তালায় লেইখা দিছে হিন্দু মুসলমান। অন্যপাশে কান রাখলে মাইকের মতো শোনাতো। ছোটবেলায় এটা আমাদের খেলা ছিল। মাঠে খেলার পর দম নেয়ার জন্য আমরা মিনারের পাদদেশে বসতাম। ১৬ই ডিসেম্বরে মিনারটি সাবান দিয়ে গোসল করানো হতো। তারপর এলাকার ছেলেমেয়েরা এসে ফুল দিতো। বেশির ভাগই গাঁদা ফুল। অন্যান্য ফুলের মধ্যে বোগেনভেলিয়া আর গোলাপ। মোহাম্মদীর নাসিরউদ্দিন আর বাঘাদের বাগান থেকে সেদিন কিছু ফুল চুরি যেতো। সব এখন লোকে ভুলে গেছে। স্কুলের দেয়াল উঁচু হওয়ায় এখন আর বাইরে থেকে মিনারটা দেখা যায় না। স্কুলের এদিকটায় উন্নয়নের কাজ চলছে।
উন্নয়নের ফলে এখন আর মানুষের কোনো সমস্যা নেই। মোগল নাই। বৃটিশ নাই। পাকিস্তান নাই। আমরা এখন স্বাধীন রাষ্ট্র। রাস্তার মোড়ে মোড়ে সরকার সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা। সুতরাং দেশে ভিক্ষুক নাই। বাজারে গেলে অনাহারি নারী-পুরুষ কিলবিল করে। সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ায়। এরা সরকারি নির্দেশ অমান্য করছে। এরা বিদ্রোহী। আমাদের খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নাই। চাইলে আমরা অন্য দেশে রপ্তানি করতে পারি। মাঝে মাঝে এমন অতিরিক্ত ফলন হয় ক্ষেতেই ফসল পড়ে থাকে। আমলা, সৈন্য, দলীয় ক্যাডার বাহিনী মাঠে নেমে পড়ে ফসল কাটার জন্য।
নতুন নতুন সব শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। বেকার সমস্যা তো নেই-ই বরং পাশের দেশের লোক এসে এখানে কাজ করছে। আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যা নেই। গ্যাসের সমস্যা নেই। খাল-বিল-নদীর সঙ্গে শিল্পকারখানার খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। বর্জ্য বহনকারী এসব খাল-বিলে টলটলে কালো পানি। সেসব আহার স্নানে ব্যবহারের পর চুলকানি হয়। তার জন্যে কবিরাজি মলম খুবই সহজলভ্য এবং সাস্রয়ী। হাটে-ঘাটে, মোড়ে মোড়ে মাইকিং করে মলম বিক্রি হয়।
আমাদের যেকোনো সমস্যা নাই তা আমরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মিডিয়া মারফত জানতে পারছি। মিডিয়ার খবরে আরও জানতে পারছি আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের আদালত ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাধীন। আদালতের ভেতর এক ব্যারিস্টারের দল আরেক ব্যারিস্টারের গায়ে চাইলেই হাত তুলতে পারে। চাই কি জামা-কাপড় খুলে নিতে পরে। মাথা ফাটিয়ে দিতে পারে। পুলিশ কোনো বাধা দিবে না। প্রয়োজনে নির্বিঘ্নে চলে যেতে সাহায্য করবে। আসামি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আদালত বিব্রতবোধ করবে। এর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা গাছেও ধরে না। স্বাস্থ্য খাত আর দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স। চিকিৎসাসেবা অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। টিউমার ফেলতে গিয়ে জরায়ু ফেলে দিচ্ছে। খৎনা করাতে গিয়ে নুন্টু কেটে দিচ্ছে। সে এক এলাহী কারবার। আর মানুষ এখন মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বেগুনি আর বাঁধাকপির পিয়াজু খায়। পুলিশ প্রধান আসামিকে জামাই আদর করে তিন তারকা হোটেলের খাবার খাওয়ায়। অভাব জাদুঘরে চলে গেছে। তবু রাতের শহরে কিছু বেয়াদব জনগণ ফুটপাতে শুয়ে থাকে। কম্যুনিস্টরা নেই বটে। তবু তাদের প্রেতাত্মারা পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক সরকারকে বিব্রত করছে।
একটা বইমেলা হয়ে গেল। হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার। হাজার হাজার বই বের হলো। প্রতিদিন মোড়ক উন্মোচনের মড়ক লেগে রইলো। সিনেমা হচ্ছে। নাটক হচ্ছে-টেপার বউ যে রাতে হেসেছিল। এরই মধ্যে ভিক্ষা সফলতায় বিদেশ ভ্রমণ চলছে। মঞ্চে ঢোল বাজছে তো বাজছেই। নিজেরাই নিজেদের পুরস্কৃত করছে। ছবি তুলে পোস্ট দিচ্ছে। আবার নিজের ছবিতে নিজে লাইক দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক দলগুলো একেকটা যেন ক্রেস্টের দোকান। কোথাকার মাল এনে কোথায় ঢালছে। পুরস্কার দেয়ার যোগ্য কিনা, নেয়ার যোগ্য কিনা কিচ্ছু আসে যায় না। শুধু ক্লিক ক্লিক আর ক্লিক। তারপর পোস্টাইতে থাক।
একদিকে মাহফিল। আরেকদিকে রক সংগীত। প্রতি শুক্রবার জুমায় মাইকে চিৎকার করে ইবাদত করছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে জিগির করছে। চারিদিক ভূকম্পিত করে আওয়াজ তুলছে যাতে আকাশ ভেদ করে আওয়াজ খোদার আরশে চলে যায়। সুসজ্জিত মডেল মসজিদ প্রস্তুত। আরেকদিকে এক মিনিট কথার সঙ্গে পাঁচ মিনিট ড্রাম বাজাচ্ছে। গানের উত্তেজনায় গায়কের সঙ্গে দর্শক শূন্যে লাফাচ্ছে। চুল ছিঁড়ে ফেলছে। জামা ছিঁড়ে ফেলছে।
একটু পরপর উন্নয়ন ব্রিজ। এক ব্রিজ পার হয়ে আরেক ব্রিজ। দুই ব্রিজের মাঝখানে পুলসিরাত। কোথাও আবার ব্রিজের ওপারে ধানক্ষেত। ব্রিজে ওঠা যায় আর নামা যায় না। প্রতি বারো মিনিট পরপর মেট্রোরেল বুকের ওপর দুমদুম শব্দ করে চলছে। সারা দেশের যেখানে খুশি ছয় ঘণ্টায় চলে যাওয়া যায়। নদীর উপর ব্রিজ হয়ে গেছে। নদীর মাঝখানে চাষবাস হচ্ছে। এখন আর আদর্শগত কোনো সমস্যা নাই। সকলে একই চেতনার লোক।
‘এক আল্লাহ এক পিতা
রামের বউ সীতা।
বামে আর ডানে আর
কোনও ভেদ নাই।
জিবলা অতি পিছলা তাই
ধরতে লাগে ছাই।’
সকল ভেদ লুপ্ত হয়ে এখন এক কাঁধে লেলিন আরেক কাঁধে গান্ধি। আমেরিকা তত্ত্ব দিছে এসব বিশ্বায়নের সন্ধি। পুতিন মোদি ভায়রা ভাই। বাইডেন মোগো নাতজামাই। মানুষ এখন বেশির ভাগ সময় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেই নিজের ছবি তোলে। পোস্ট দেয়। ইমুজি দেয়। ফেসবুক মেমোরি ফিরিয়ে দেয়। তাই দেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা দেয়। কেকের ছবি দেয়। ফুলের ছবি দেয়। মুখোমুখি দেখা হলে চিনতে পারে না। চলছে খেলা হরদম হরদম। নাচে গানে মহরম মহরম।
বড়ো মামারও একটা জন্মদিন ছিল। হয়তো একজন নয়তো কয়েকজন বান্ধবী ছিল। কেউ সেসব মনে রাখেনি। মামা বিয়ে করেনি। বিয়ে করলে হয়তো আমার সমান ছেলে বা মেয়ে থাকতো। তারা একটা সার্টিফিকেট চেয়ে আনতো। সেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোটা সুবিধা নিতো। বাড়ি বরাদ্দ পেতো। আমার মতো কাজের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না। বাবাকে একবার সার্টিফিকেটের কথা বলেছিলাম।
তুমিও তো চাইলে একটা সার্টিফিকেট পাও।
কি হবে ঐ কাগজ দিয়ে।
একটা স্বীকৃতি পাবে।
কে দেবে স্বীকৃতি।
মন্ত্রী মহোদয়।
তাকে স্বীকৃতি দেয় কে? শোন ঐ কাগজের জন্য যুদ্ধে যাইনি।
তোমার না হোক আমার তো কাজে আসতো।
যোগ্যতার বাইরে বেশি সুবিধা চেয়ো না। দেশটা সকলের।
বাইরের লোক মনে রাখবে কী। পরিবারের কেউ আর বড়ো মামাকে মনে রাখেনি। নানি যতদিন জীবিত ছিলেন, মার্চ মাস আসলে মনে করতেন।
বড়ো খোকার সাহস আছিল। কী আর বয়স তখন। ভালো কইরা দাড়ি-মোছ উঠে নাই। আইয়ুব খানের কার্ফ্যু ভাইঙ্গা সামনে গেছে। গজারি লাকড়ি হাতে মিছিল করছে। ইয়াহিয়ার পুলিশের কাছে গুলি খাইছে। তরা কেউ ওর মতন হস নাই। তরা ঘরে বইয়া টেলিভিশনের সামনে চিল্লাস। তগো পুঁটি মাছের আত্মা। পুঁটিও না তিতপুঁটি।
আমার এসব কথা মনে পড়ে। আমার কোনো কাজ নাই। এই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি বেকার। আমি মাঝে মাঝে কাজ পাই। এখন কাজ নাই। উন্নয়নের ফলে এখন আর অনেক কাজ করতে হয় না। আমি একটা বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। সামাজিক অবক্ষয় বৈষম্য নিয়ে এরা গবেষণা করতো। বর্তমানে সরকারি তথ্য মতে, আমাদের সামাজিক বৈষম্য নেই বললেই চলে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পা দিয়েছি। সুতরাং অনুদান বন্ধ হয়ে যায়। আমার কাজটি চলে যায়। এখানে এখন আর গরিব নাই। বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন নাই। আমরা বরং চাইলে উন্নত দেশকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি। পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান গদ গদ হয়ে সাংবাদিকদের এসব বলেছিলেন।
বেকার হলেও প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। কখনো শহরের পশ্চিম দিকে। কখনো শহরের উত্তর দিকে যাই। শহরের দক্ষিণ দিকে খুব একটা যাওয়া যায় না। সেদিকে দুই কিলো যাওয়ার পর বুড়া বুড়িগঙ্গা। তার পানি পচা কাজল কালো। দুর্গন্ধ ভেদ করে নৌকায় পারাপার করতে হয়। একবার গিয়েছিলাম মামুদের ওখানে। মামুদ আমাদের স্কুলের বন্ধু। শিল্পী হবার আশা নিয়ে চারুকলা থেকে পাস করেছে। এখনো রঙ নিয়েই কাজ করে। সাইনবোর্ড ব্যানার লেখে।
পুবদিকে খুব একটা যাওয়া হয় না। ওদিকটা এখনো পুরো শহর হয়ে ওঠেনি। শহর বেড়েছে উত্তরে এবং উত্তরোত্তর বাড়ছে।
পায়ে হেঁটে যতটা যাওয়া যায়। মাঝে মাঝে ঘুরে আসি। আগে রাস্তার ধারে বানরখেলা দেখতাম। দয়াগঞ্জ পুলের উপর খুব জাদুখেলা দেখাতো। একটা কিশোরী মেয়েকে সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলতো। তারপর মানুষের একটা হাড় হাতের মুঠোয় চেপে ধরে যাদুকর মন্ত্র বলতে বলতে লম্ফঝম্প করতে করতে গোল হয়ে বসে থাকা জনতার চারপাশে চক্কর দিতো। সবাইকে বলতো হাতের মুঠো আলগা করে দিতে। তা না হলে যাদু কাজ করবে না। তারপর চিৎকার করে লাফ দিয়ে বলতো- কই গেলিরে পোলাপান কাইন্দা কাইট্টা পয়সা আন। সিকি আনি আধুলি যার যা কিছু আছে ফেলে দেন। মেয়েটা কষ্ট পাইতাছে। চারদিক থেকে উড়ে উড়ে পয়সা আসতো। যাদুকর হিংস্র ভঙ্গিতে ছুরি চালায়। উপস্থিত জনতা দেখে চাদরের নিচ থেকে রক্ত গড়িয়ে আসে। উত্তেজিত জনতা হাততালি দেয়।
প্রেস ক্লাবের সামনেও হাততালি দিচ্ছে। ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন লাল পতাকাধারীকে পুলিশ পল্টনে আটকে দেয়। পুলিশ প্রায় শ’ খানেক। লালজীবীদের প্রেস ক্লাব যেতে দিচ্ছে না। অগত্যা তারা সেখানেই বসে পড়ে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সরকার, প্রশাসন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলে। এখানে শ্রোতার চেয়ে বক্তা বেশি। সেটা অবশ্য প্রেস ক্লাবেও। এখানে আরেক দল। এরা তেল গ্যাস দুর্নীতি ব্যাংক লুট নিয়ে প্রতিবাদী বক্তৃতা দিচ্ছে। বক্তা বক্তৃতার শেষে সরকারি দলের স্লোগান দিচ্ছে। এ এক নতুন ধরনের যাদু। এখানেও বাচ্চলোক করতালি দিয়ে সমর্থন জানাচ্ছে। এসব বেশি দেখলে কেমন একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়। ভাবলাম বড়ো মামা থাকলে এখন কী করতো। তার কথা সবাই ভুলে গেছে। আমিও ভুলে গেছি।
এলাকায় ঢুকে মিনারের খবর নিলাম। সবাই ভুলে গেছে। বহু বছর পর স্কুলে ঢুকলাম। স্কুলের মাঠ অনেক ছোট হয়ে গেছে। পুরনো ঘরটা নাই। সেখানে নতুন দালান। আম গাছ কাটা গেছে। ডাব গাছ কাটা গেছে। মাঠ থেকে এখন আর দীপাদের দোতলার বারান্দা দেখা যায় না। মিনারের কোনাটি দিনের বেলায়ও কেমন অন্ধকার। কাছে গেলে ঝাঁঝালো অম্লীয় গন্ধ। মিনারের মাথা ভাঙা। চোখের অংশগুলো নাই। গায়ের মোজাইকগুলো মুছে গেছে। বাকিটা ক্ষয় হয়ে হয়ে ইটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ভাঙা মিনারে হাত রাখলাম। গা শিরশির করে উঠলো। চারিদিকে তাকালাম। কেউ নেই। হকচকিয়ে গেলাম। কথা কয় কে। মিনারের গায়ে আবার হাত রাখলাম। সেই একই গলা।
এতদিনে মনে পড়লো?
এ তো বড়ো মামার গলা। আমি ঠিক জানি না। কিন্তু বুঝতে পারছি। মামা আমার সঙ্গে কথা বলছে।
তুমি কে?
আমাকে চিনতে পারছিস না। আমি তোর বড়ো মামা।
সে জানি। কিন্তু তুমি তো কবেই মরে ভুত হয়ে গেছো।
আরে সে তো আমার দেহের মৃত্যু হয়েছে।
আর আত্মার মৃত্যু হয়নি?
না। কক্ষণো না। খবর নিয়া দেখ, সব ধর্মই বলে- আত্মার মৃত্যু নাই।
ধ্যাৎ, এসব আর এখন কেউ বিশ্বাস করে না।
একটু গীতা-টিতা পড়। বুদ্ধকে বোঝ। সুফিতত্ত্ব দেখ। লালন শোন।
তুমি তো মিছিলে গুলি খেয়েছিলে। এসব জ্ঞানের কথা বলছ কেন?
তোরা মানে আমাদের পরের প্রজন্ম যাতে স্বাচ্ছন্দ্য জীবন পায় তাই আমরা মিছিলে যেতাম।
আমরা তো তোমাদের ভুলে গেছি।
আমাদের বিশ্বাস ছিল এ দেশ আমাদের কোনোদিন ভুলবে না। হৃদয় থেকেই তারা আমাদের সম্মান জানাবে। আমার বন্ধুরা মিনারে একটা নামফলক পর্যন্ত দেয়ার দরকার মনে করেনি।
স্কুল থেকে বের হয়ে উল্টো পাশে মুদির দোকানের কালাম মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু বলতে পারে না। সেলুনের হানিফ শেখ সেও কিছু জানে না। ফুচকা মামা তেঁতুলের টক গুলতে গুলতে দাঁত বের করে শুধু হাসলো। পুরির দোকানের রশিদ বললো, সারাদিন হালায় চুলার গোয়ায় লাকড়ি গুতাইতে গুতাইতে জীবন শেষ। এইসব খবর ক্যামতে রাখুম। দেশের গোয়ামারা শেষ আর তুমি আছো মিয়া মিনার লইয়া। তয় মনে করা পারতাছি আমরা মিনারের ঘাড়ে উইঠা খেলতাম। ঝাপসা মনে আছে।
স্মৃতিস্তম্ভের প্রতি এত অসম্মান মেনে নেয়া যায় না। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু আমার টাকা-ক্ষমতা কোনোটাই নাই। কিন্তু কিছু একটা করতে চাই। এসব ক্ষেত্রে আমি লিলির পরামর্শ নেই। লিলি সবসময় আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। কিছু কিছু বিষয় লিলি আমার চেয়ে আগেই বুঝে ফেলে। যেমন আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে সে আগেই টের পেয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। আমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় বলেও জানিয়ে দেয়। আমার সঙ্গে দিব্যি হাসি হাসি মুখে কথাও বলে। মাঝে মাঝে আবদার করে কফি খায়। আমি লিলিকে কল দিলাম।
হ্যালো লিলি।
কী খবর?
তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
হ্যাঁ,বলো।
ফোনে বলবো না।
ফোনে বলবে না তবে দেখা করবে?
দেখা করে বলাই ভালো, অনেক কথা।
আমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে?
না।
মন খুব ছটফট করছে?
না তো!
রাতে ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে তো?
তা হচ্ছে।
তা হলে ঠিক হয়ে যাবে।
কী?
প্রেমে পড়নি সেটা নিশ্চিত। প্রেমে পড়লে ওসব হয়।
একটা সিরিয়াস পরামর্শ দরকার।
যাক তাহলে একটা সিরিয়াস বিষয়ে কথা হবে। আমি একটু পর জিমে যাবো। সাইকেলিং করে ঘণ্টাখানেক পর বের হবো। তুমি লা-ভিঞ্চিতে আসো। একটা লেমন ড্রিঙ্ক চুমুক দিতে দিতে কথা হবে।
সমস্যা যেখানে সেখান থেকে শুরু করতে হয়। লিলি সবকিছু শুনে প্রথমে স্কুলে কথা বলার পরামর্শ দিলো। লিলির কথামতো স্কুলে চলে গেলাম।
স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে বললাম, এই দালানের ঠিক পেছনে দক্ষিণ পুব-কোনায় একটা স্মৃতিস্তম্ভ ছিল।
তাই নাকি!
আমরা বলতাম মিনার।
আমার চোখে কখনো পড়েনি।
পুবদিকের চিপায় পড়ে আছে। এখনো ধ্বংসস্তূপ আছে।
ও আচ্ছা।
মিনারটা আমার বড়ো মামার স্মৃতি রক্ষায় বানানো হয়েছিল।
দেখুন আমি তখন ছিলাম না।
আপনার না থাকারই কথা।
তাহলে আমি কি করতে পারি।
মিনারটি আবার স্বস্থানে ফিরে আনার ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া-
তাছাড়া কি?
এটা করতে শুধু টাকা নয় অনুমতির প্রয়োজন।
কার অনুমতি?
এক কাজ করুন। স্কুল কমিটিকে অবগত করুন।
স্কুল কমিটি কয়েক ভাগে বিভক্ত। সাদা দল। নীল দল। সাদা আর নীল মিলে আরেকটা আকাশী দল। সাদা দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। এরা খুব হতাশ। এ আসে তো সে আসে না। একজনকে পাওয়া গেলে আরেকজনকে পাওয়া যায় না। একজন আরেকজনকে দোষ দেয়। শেষে একজন বললো, ভাই আমরা তো ক্ষমতায় নাই। আমরা কিছু করতে পারবো না। এটা তো কাজই না। ক্ষমতায় আসলে এর চেয়ে অনেক বড়ো কাজ নিয়ে আসবেন করে দেবো।
তারমানে যারা ক্ষমতায় আছে তারা কাজটা করতে পারবে। মামার সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তারা সবাইকে হেয় করে কথা বলে। তবু আমি তাদের কাছে যাবো। বড়ো মামার সম্মান ফিরিয়ে আনতে আমি সবকিছু করতে পারি। গেলাম নীল দলের কাছে। তাদের একসঙ্গে পাওয়া গেল। সারাক্ষণ ভাগবাটোয়ারা আর আতর গোলাপ মেখে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে তারা তৈরি হয়ে সকালে বাসা থেকে বের হয়। তাদেরকে এক টেবিলে পাওয়া গেল। জানালাম আমার মামা বেলায়েত হোসেন স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই মিছিলে গুলি লেগে শহীদ হন। তার স্মরণে একটা স্মৃতি মিনার ছিল। বিভিন্ন চেয়ার থেকে কথা বলা শুরু হলো।
তাহলে কি তিনি মুক্তিযোদ্ধা?
তখন তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি।
তার কোনো সার্টিফিকেট আছে?
কোন সেক্টরের আন্ডারে যুদ্ধ করেছে?
তখন কোনো সেক্টর তৈরি হয়নি। যুদ্ধের ঘোষণা আসেনি।
তাহলে সে কোনো যুদ্ধ করেনি।
প্রতিবাদ মিছিলে ছিল। সেখানে গুলি হয়।
কেসটা একটু জটিল। হাই-কমান্ডের পরামর্শ লাগবে।
পাওয়া যাবে না এমন নয়। সম্ভব। তবে ডকুমেন্ট ছাড়া একটু বেশি খরচ হবে। সবুজ বার্তা বা লাল বার্তায় নাম থাকলে কাজটা সহজ হতো। খরচপাতি কম লাগতো।
আমার কোনো সনদের দরকার নেই। যে সম্মানটুকু ছিল আমি শুধু ততটুকুই চাই।
কী সেটা?
ঠিক একই জায়গায় আবার মিনারটা চাই।
না না নতুন কোনো মিনার হবে না।
এটা নতুন নয় পুরাতন।
এখন তো নাই।
আপনারা ভেঙে ফেলেছেন। উন্নয়ন করতে গিয়ে মিনার গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।
দিবেই তো। হারু-নীরু-রাজু-সাজুর নামে এত স্মৃতি রাখা যাবে না। যদি কোনো মিনার, স্তম্ভ, ভাস্কর্য বানাতে হয় তা হবে একমাত্র কাকিমার নামে। না হয় কাকির কাকার নামে। বনে-জঙ্গলে-জলে-স্থলে যেখানেই বিপদ হবে কাকিমা আমাদের রক্ষা করেন।
তারপর তারা টেবিল চাপড়ে স্লোগান ধরলো।
কাকিমা আছে যেখানে আমরা আছি সেখানে।
কাকিমার কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
আমি ঘরের চারিদিকে কাকিমাকে দেখতে পেলাম না। দেয়ালে দেখলাম কাকিমার কাকা আমাদের নানাভাই আর কাকিমার সাদাকালো ছবি। আর কাকিমার কী হবে কেন ঘরে ঘরে আগুন জ্বলবে বুঝতে পারলাম না। সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
আকাশী দলের কাছে যাবো কি যাবো না ভাবছি। এমন সময় ওরাই আমাকে যোগাযোগ করতে বললো। প্রথমেই আমাকে ভর্ৎসনা করলো ভুল জায়গায় যোগাযোগ করার জন্য। শুরুতেই নাকি তাদের কাছে আসা উচিত ছিল। এখন নীল দল শেষ সম্ভাবনাটুকুর গায়ে পেরেক ঠুকে দিবে।
তুমি ওদের পথ দেখিয়ে দিলে।
কীভাবে?
ওরা এখন দেশপ্রেমিক বেলায়েতের স্মৃতি মিনারের জায়গায় নানাভাইয়ের ভাস্কর্য বানাবে।
কী করে জানলেন?
সারা দেশে তাই করছে। নানাভাইয়ের হাতে যে চুরুট দেখতে পাও তার দাম পড়ে কয়েক লাখ টাকা। এখানে একবার নানাভাইকে বসাতে পারলে তার দেহরক্ষী ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ভাতা সবমিলিয়ে মাসে মাসে লাখ টাকার ওপর বরাদ্দ পাবে।
পাথরের মূর্তির দেহরক্ষী লাগবে কেন?
ওই যে সাদা দল-
সাদা দল কী করবে?
ওরা তো চেতনায় বিশ্বাস করে না। সুযোগ পেলেই নাকটা ভেঙে দিবে। নয়তো আঙুলটা কেটে নিবে। তাই পাথরের নানাভাইকে চব্বিশ ঘণ্টা সশস্ত্র পাহারায় থাকতে হয়।
আমি এখন কী করবো?
তোমার সর্বপ্রথম কাজ হলো থানায় সাধারণ ডায়রি করা।
ডায়রিতে কী লিখবো?
ঐ যারা তোমার স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তাদের আসামি করবে।
আমি জানি না কাজটা কারা করেছে।
তাতে কী। তুমি তো অনুমান করতে পারো। যাদের যাদের সন্দেহ করো তাদের আসামি করে মিনার উদ্ধারের আবেদন করো।
এর আগে কখনো থানায় যেতে হয়নি। জিডি লিখতে হয়নি। যাদের যেতে হয়েছে এরকম একজন বললো, থানাতেই একজন অফিসার থাকেন তার কাছে ফরমেট করা থাকে। তিনি সাজিয়ে লিখে দেন। এখন আর লিখে নিতে হয় না। কিন্তু মন সায় দিল না। নিজেই একটা লিখে নিয়ে যাই। সারাদিন কাটাকুটি করে একটা দরখাস্ত লিখলাম।
মাননীয়
থানা প্রধান
কাঠেরপুল থানা
ঢাকা দক্ষিণ
বিষয়: স্মৃতির মিনার পুনরুদ্ধার।
মহোদয়
যথাযথ সম্মানপূর্বক আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আপনার কাঠেরপুল থানাধীন গঞ্জিঘাট এলাকার শত বছরের পুরাতন বেগমঘাট স্কুল মাঠে অর্ধশত বছরের পুরোনো একটি স্মৃতি মিনার ছিল। সম্প্রতি এলাকাবাসী অবগত হয় কে বা কাহারা মিনারটি আংশিক চুরি করেছে। বর্তমানে মিনারটির অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু বিলুপ্তপ্রায়। এই মিনারটির সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্র জাতি সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান।
আপনার নিকট আকুল আবেদন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিবেন এবং ছিনতাই হয়ে যাওয়া স্মৃতিস্তম্ভ পুনঃস্থাপনে সহযোগিতা করবেন।
আশাকরি এই আবেদন সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করে মিনারটি আপনার মাধ্যমে পুনঃস্থাপিত হবে।
ইতি
শহীদ বেলায়েত হোসেনের পক্ষে
স্বপন মুণ্ডা
চিঠিটা শেষ করে ভাবলাম থানায় একা যাবো না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাই। প্রথমে বাদলকে বললাম। বাদল বললো যেতে পারবে না। বউকে নিয়ে মার্কেটে যেতে হবে। এরপর বাবলুকে বললাম। বাবলু বললো, সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। অবশ্য থানায় গেলে সন্ধ্যার পরপর যাওয়া ভালো। কিন্তু সন্ধ্যার পর বাবলু কেরামবোর্ড খেলবে। সেজন্য যেতে পারবে না। তারপর বললাম রফিককে। রফিক বললো, অন্য কাউকে নিয়ে যা। আমার বউ দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকা পছন্দ করে না।
এরপর আর কাউকে বলার ইচ্ছা রইলো না। চিঠিটা সুন্দর করে ভাঁজ করে চলে এলাম থানায়। থানা বেশ জমজমাট। লোক গমগম করছে। দায়িত্বে থাকা পুলিশ দ্রুত চিঠির ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন।
ওপাশের টেবিলে যান। কীভাবে লিখতে হবে দেখিয়ে দিবে।
আমি তো লিখেই এনেছি।
হয়নি। সাধারণ ডায়রিতে চুরি ছিনতাই এসব লেখা যাবে না।
তবে কী লিখবো?
লিখতে হবে হারিয়ে গেছে।
কেন?
অযথা প্রশ্ন করবেন না। যা বললাম করেন। আমাদের এলাকায় কোনো ধরনের চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে না।
তারমানে?
এতে থানার সুনাম নষ্ট হয়। ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বুঝতে পারছেন। আপনার একটা জিনিস ছিল। হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যেতেই পারে। আমরা খুঁজে দেখবো। ঠিক কোন জায়গাটায় হারিয়েছে সেটা ঠিক করে লিখতে হবে। পাওয়া গেলে আপনার জিনিস আপনি মানি রশিদ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আমরা জিরো টলারেন্স অবস্থায় আছি। সবকিছু নজরদারিতে রাখছি।
বুঝতে পারলাম।
আপনার কী হারিয়েছে?
ঠিক আমার না আমার মামার
কী?
স্মৃতিস্তম্ভ।
আপনি কেন এসেছেন। মামাকে পাঠিয়ে দিন। যার ডায়রি তাকেই করতে হবে।
মামা নেই।
নিয়ে আসুন।
তিনি পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন।
পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। নিশ্চয়ই টেরোরিস্ট।
না তিনি একজন দেশপ্রেমিক।
সে আদালত ঠিক করবে। আপনি বলার কে। আর কী প্রমাণ আছে সে দেশপ্রেমিক?
প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে সমাবেশের দিকে যাচ্ছিলো। পথে পুলিশ গুলি করে।
গুলি করবে না তো কি পুলিশ চকলেট খাওয়াবে। উনি প্রতিবাদ করবে আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখবে। দেশপ্রেমিক মানুষ খুবই বিপজ্জনক হয়। শেষে ফ্যাসিস্ট হয়ে যায়। হিটলারকে জানেন তো।
আমার অভিযোগ একটু ভিন্ন ধরনের। যদি ধৈর্য ধরে শোনেন তো খুব সংক্ষেপে বলি।
বলুন,
মামা মারা গেছে গুণে গুণে তিপ্পান্ন বছর আগে। তার স্মৃতিতে স্কুলের মাঠে একটা মিনার ছিল। স্কুলের উন্নয়ন করতে গিয়ে কে বা কারা মিনারটি ভেঙে ফেলে। তারপর সেখান থেকে মিনারটি আংশিক সরিয়ে ফেলে।
আপনি কী চান?
যারা উন্নয়নের নামে স্মৃতি ধ্বংস করছে তাদের এরেস্ট করুন।
সম্ভব নয়।
কেন?
আমি উন্নয়ন সমর্থন করি। আর কে না উন্নয়নের সমর্থক।
সেটা তো ধ্বংস না করেও করা যায়।
আপনার নাম কী বললেন?
স্বপন মুণ্ডা।
স্বপন বুঝলাম। মুণ্ডাটা কী?
মুণ্ডা হলো এলাকার প্রধান।
আপনি কি এলাকার প্রধান?
না।
আচ্ছা নামের সঙ্গে কাজের মিল নাই। তা অনেকেরই থাকে না।
নামের যোগ্য হতে পারিনি। বাবার সেরকম ইচ্ছা ছিল। তাই মুণ্ডা নামে ডাকতো।
মিনারটা স্কুলের ভেতরে ছিল না বাইরে?
স্কুলের ভেতরে। সীমানা প্রাচীরঘেঁষে।
এটা কি সরকারি স্কুল?
অবশ্যই সরকারি স্কুল।
সমাধান হয়ে গেল!
কী সমাধান!
সোজা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে যান। এর সমাধান তারাই দিতে পারবে। তাদের স্কুলের ভেতর কী থাকবে না থাকবে এটা তাদের ব্যাপার।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গেলাম। সেখানে নানান ভাগ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা। আবার কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা। শেষ পর্যন্ত এরা পাঠিয়ে দিল ভূমিমন্ত্রকে। ভূমিমন্ত্রক জানালো এটা কোনো জমি বিষয়ক জটিলতা নয়। এটা নকশাকারের সমস্যা। নকশায় ওই অংশটুকু বাদ দিলেই হতো। আপনি এক কাজ করেন নকশা বিভাগে যোগাযোগ করেন।
নকশা বিভাগ বললো, যা ঘটে গেছে তা তো আর ফিরে আসবে না। আবার নতুন করে লে-আউট দিতে পারলে নকশা সংশোধন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে দুটি কাজ করতে হবে। এক. আগের ডিজাইনটা করে আনতে হবে। দুই. যেহেতু এটা একটা স্মৃতি মিনারের ব্যাপার, আপনাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে কথা বলতে হবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সোজা কথা বললো। স্মৃতি-টৃতি নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। উন্নয়নের অংশ হিসেবে আমরা চেতনার কেতন উড়িয়ে নানাভাইর স্কাল্পচার গড়লে বরাদ্দ দেবো। আর তা ছাড়া এ ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত নাই। এবিসি থেকে এসব শর্তেই আমরা ফান্ড পেয়ে থাকি।
না না এটা ঠিক হলো না। এবিসি আমাদের স্মৃতি ধ্বংস করে একতরফাভাবে বরাদ্দ দিতে পারে না। এটা কোনো আন্তর্জাতিক নীতি হতে পারে না। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু গণমানুষের সমর্থনের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নাই। এ হতে পারে না। সারা বিশ্বে স্বৈরাচার একনায়ক সামরিক সব সরকারেরই তারা সমর্থক। তাদের নৈতিকতা যা হোক, আমার স্মৃতির মিনার তাদের প্রশ্রয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর জবাবদিহি তাদের করতে হবে। তাদের হেড অফিস আমেরিকায়। সেখানে যেতে পারবো না। কিন্তু ইমেইল দিতে পারবো।
লিলি একটা সহজ সমাধান দিলো। এবিসির প্রতিনিধি প্রায়ই এখানে আসেন। তার সঙ্গে দেখা করে আবেদনটি তুলে ধরতে। তার সঙ্গে বৈঠক ব্যর্থ হলে হেড অফিসকে মেইল দেয়া যেতে পারে।
এবিসির প্রতিনিধি সবদেশেই আছে। বাংলাদেশের প্রতিনিধির নাম উইলিয়াম ফক্স। ফক্সের সঙ্গে মুণ্ডার একটা বৈঠকের চেষ্টা চলছে।