নির্বাচিত কলাম
ভারতের জাতীয় নির্বাচন-২০২৪
কোনো সারপ্রাইজ নয়!
রেজাউল করিম রনি
২১ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবারজরিপের ফল থেকে সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে মোদি ওয়েভকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সামাজিক স্তরে গণতান্ত্রিক আবরণে স্বৈরতন্ত্র ও হিন্দুত্ববাদী শাসনকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর স্থাপন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রবলভাবে মোদি কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার সংস্কৃৃতি তৈরি করা হয়েছে। প্রবীণ রায় তার, মোদি ওয়েব-লিডারশিপ লেজিটিমেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউলাজেশন ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স- নামক গবেষণায় এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেন। লেখক আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির জয়ী হওয়াকে যাতে কোনো সারপ্রাইজ বা বিস্ময় হিসেবে না দেখা হয় এবং দেশে-বিদেশের সাংবাদিকরা যাতে মোদির আবারো ক্ষমতায় আসার প্রকৃত চিত্র সহজে বুঝতে পারেন তাই তিনি এই বিষয়টি সামনে এনেছেন বলে এক মন্তব্যে জানিয়েছেন। পরিকল্পিত অস্ত্র মোদি ওয়েভে ভর করে আবারো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বিজেপি। তাই- ভারতের আগামী নির্বাচনে কোনো সারপ্রাইজ নেই বলে তিনি মনে করেন
এবার ভারতের নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছেন ৯৬ কোটি ৮০ লক্ষ ভোটার। আগামী এপ্রিল মাসে দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সাক্ষী হতে যাচ্ছে দুনিয়া। কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণন্ত্রণ নয়, ভরতে বিজয়ী হতে যাচ্ছে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব ডেভলপিং সোসাইটিস (সিএসডিএস) এর রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রবীণ রায় সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, আসন্ন ভারতীয় জাতীয় নির্বাচনে গেরুয়া পার্টি ‘মোদি ওয়েভ’ অর্থাৎ মোদি ঢেউ বা জোয়ারকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। দীর্ঘ এই গবেষণায় তিনি বিজেপি সরকারের বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপগুলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছন, ভারতের আসন্ন নির্বাচনের রেজাল্ট অভিন্নই থাকছে।
মোদি ওয়েভ:
করোনাকালে ওয়েভ কথাটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। নির্বাচনী রাজনীতির বেলায় ওয়েভ কথাটি মার্কিন গণমাধ্যমের বদৌলতে প্রচারিত হতে থাকে ট্রাম্পের উত্থানের কালে। ওয়েভ এমন একটি রাজনৈতিক প্রবাহ যার মাধ্যমে একটি দলের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে। এই ওয়েভের প্রভাবেই জনগণ একটি রাজনৈতিক দলের অ্যান্টি অথবা প্রো-মানে পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের ফলাফল ভোটকেন্দ্র দখল করে নিজেদের পক্ষে আনার সুযোগ না থাকলেও ওয়েভ বা জোয়ার অথবা হুজুগ তুলে অনেক সময় একটি দল ক্ষমতায় চলে আসে।
আসন্ন ভারতের নির্বাচনের আগে বিজেপি বিপুল ভাবে এই ‘মোদি ওয়েভ’ তৈরির কাজ করছে। এই মোদি ওয়েভের মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের অবিকল্প নেতা হিসেবে জনগণের সামনে হাজিরের সুপরিকল্পিত যে উদ্যোগগুলো নেয়া হয়েছিল গত এক দশক ধরে তারই সামষ্টিক ফলাফল হিসেবে আবারো ভারতের ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস, যা বিজেপির ক্যাডার সংগঠন হিসেবে পরিচিত) এর সাবেক কর্মী নরেন্দ্র মোদিকে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে ঋষিপ্রতিম, চা দোকানি থেকে দেশ নেতা ইত্যাদি বিভিন্ন ফিকশনাল অনুসঙ্গে স্থাপন করে ভারতের চলতি রাজনৈতিক লোককথার নায়কে পরিণত করা হয়েছে এবং ভারতীয় সমাজে এগুলো ব্যাপক ভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রায় দুই দশক ধরে। গেরুয়া পার্টি মোদির রাজনৈতিক ক্যারিশমা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক জাগরণের জাতীয় বীর হিসেবে উদ্যাপনের এক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে গত দুই দশক ধরেই। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গুজরাটে মোদির আপাত সফল মুখ্যমন্ত্রিত্ব কাল ও দাঙ্গার ব্যাপারে নীতি তাকে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের প্রধান নেতায় পরিণত করতে সহায়ক হয়েছে। মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আর্বিভাবের কালে মিডিয়াতে বারবার উন্নয়নের গুজরাট মডেলকে হাজির করা হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালকে বিজেপি মোদি ওয়েভ তৈরির পরীক্ষামূলক কাল হিসেবে গ্রহণ করে। এবং ভারতের ইতিহাসের পুরো চরিত্রই ধীরে ধীরে পাল্টে দিতে থাকে। ভারতের গণতন্ত্র ধীরে ধীরে রূপ নিতে থাকে একটা অথরেটিটিয়ান গণতন্ত্রে। মুসলিমদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা, বিরোধী মতকে দেশদ্রোহীতার তকমা দিয়ে দমন করা। সাধারণ মানুষকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের স্বপ্নে দীক্ষিত করার জন্য মোদিকে প্র্যাকটিসিং হিন্দু হিসেবে হাজির করা, নিয়মিত মন্দিরে পূজা-অর্চনার ছবি প্রচার আর মুখে বারবার গণতন্ত্রের কথা, সবার অধিকারের কথা বলা আর সামাজিকভাবে বিজেপির বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী সাংষ্কৃতিক জাগরণের জোয়ার তৈরি করা এবং এর প্রাণ পুরুষ হিসেবে ঋষি মোদিকে হাজির করার মধ্যদিয়ে মোদি ওয়েভ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
বৃহত্তরো হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দুত্ববাদী আবেগ উস্কে দেয়া, ভারতের জনগণকে নিজের পরিবারের লোক হিসেবে চিহ্নিত করা, নিজের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক করার বদলে ব্যক্তিগত কাঠামোতে দেখা, মিডিয়াতে সংখ্যাগুরুদের জন্য নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিকে জনগণের জন্য, দেশের জন্য নেয়া উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে দেখা, সোশাল মিডিয়াতে প্রচুর ফেক নিউজ ছড়ানো, মূল ধারার মিডিয়াতে বিজেপির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন চিন্তার চরম দমন কিন্তু সেটাকে দেশের আগ্রগতির জন্য জরুরি কাজ হিসেবে প্রচার-ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি মোদি ওয়েভ তৈরিতে বিপুল ভূমিকা রেখেছে বলে দেখিয়েছেন প্রবীণ রায়। ভারতের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপের পক্ষে যা কিছু ক্ষতিকর মোদি সেগুলোকে দেশের গৌরব হিসেবে আখ্যায়িত করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক শিক্ষিত লোকদেরও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে ভারতের গণতন্ত্র এখন কেবল একটা খোলস হিসেবেই টিকে থাকবে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
নির্বাচনের আগে বিশাল আয়োজন করে রাম-মন্দির উদ্বোধন, মুসলিম বিরোধী নাগরিক আইন কার্যকর করা, এর আগে কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা (৩৭০ ধারা) বাতিল করা ইত্যাদি বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধের কাজগুলোকে ভারতের এগিয়ে যাওয়া ও সমৃদ্ধির পথে যাত্রা হিসেবে প্রচার করে হিন্দুত্ববাদী সাধারণ জনতার কাছে মোদিকে এক অবিকল্প নেতা রূপে হাজির করা হয়েছে।
অন্যদিকে দুর্বল বিরোধী দল, শক্তিশালী প্রতিবাদ, প্রতিরোধ না থাকায় ভারতের সাধারণ মানুষের চোখে মোদির বিকল্প কেবল মোদি।
বিজেপির নিকট প্রতিযোগী কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মোদির জনপ্রিয়তার একটা তুলনা উঠে এসেছে সিএসডিএস এর একটি জরিপে। তাতে দেখা যায়: ২০১৪ সালে রাহুলের জনপ্রিয়তা ছিল ৩৫ ভাগ, আর মোদির ছিল ৪৪ ভাগ। ২০১৯ সালে রাহুল ১৪, মোদি ২৪, ২০২৩ সালে রাহুল ৩২ আর মোদি ৫০ ভাগ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে মোদির আমলে অভাবনীয় অবনতি ঘটেছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। আইন-আদালতও মোদির জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির প্রভাবের বাইরে নেই। অনেক বিষয়ে আদালতের রায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছে। আদালতের রায়ে বাবরি মসজিদ হয়ে যায় রাম মন্দির আর এর ফলে মোদি ওয়েভের একটা লেজিটেমিসি বা বৈধতা সাধারণ মানুষের কাছে তৈরি হতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যায়।
মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, গরুর মাংস নিয়ে সামাজিক উত্তেজনা তৈরি ও ইতিহাসের পুনঃলিখন ভারতে গণতন্ত্রের আদলে যে ধরনের শাসন কায়েম হয়েছে তাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নৈর্বাচনিক স্বৈরতন্ত্র।
ভারতের পাঠ্য বইগুলো থেকে মুসলিম আমলের ইতহাস বাদ দেয়া, ইসলামী স্থানগুলোর হিন্দু নামকরণ ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যোগও ভারতের সামাজিক স্তরের বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
২০২০ সালে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকে ভারত ২৭তম থেকে একটানে ৫৩তম অবস্থানে নেমে গেছে। এ ছাড়া ফ্রিডম হাউস এবং ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের (ভি-ডেম) মতো অনেক সংগঠন ভারতকে এখন গণতন্ত্র বলা যাবে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছে। ভি-ডেম ভারতকে একটি ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সরকারের সঙ্গে যেকোনো ধরনের মতপার্থক্যকে ‘দেশবিরোধী’ এবং হিন্দুত্বের যেকোনো সমালোচনাকে ‘হিন্দুবিরোধী’ তকমা দেয়ার কাজটি বিজেপি ক্রমাগত করে যাচ্ছে। এসব করে বিজেপি তার শাসনের যেকোনো ধরনের বিরোধিতাকে অন্যায্য ও অবৈধ হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২৩ সালের গ্লোবাল অ্যাটিচিউড সার্ভেতে দেখা গেছে, জরিপকারীদের প্রশ্নের জবাবে আশ্চর্যজনকভাবে ৮৫ শতাংশ ভারতীয় উত্তরদাতা বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনকেই তারা তাদের দেশের জন্য ভালো মনে করেন। মোট ২৪টি দেশের মধ্যে এই জরিপে এমন প্রতিক্রিয়া ভারতেই সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
এই জরিপের ফল থেকে সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে মোদি ওয়েভকে কাজে লাগিয়ে ভারতের সামাজিক স্তরে গণতান্ত্রিক আবরণে স্বৈরতন্ত্র ও হিন্দুত্ববাদী শাসনকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর স্থাপন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রবলভাবে মোদি কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার সংস্কৃৃতি তৈরি করা হয়েছে।
প্রবীণ রায় তার, মোদি ওয়েব-লিডারশিপ লেজিটিমেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউলাজেশন ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স- নামক গবেষণায় এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত তুলে ধরেন। লেখক আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির জয়ী হওয়াকে যাতে কোনো সারপ্রাইজ বা বিস্ময় হিসেবে না দেখা হয় এবং দেশে-বিদেশের সাংবাদিকরা যাতে মোদির আবারো ক্ষমতায় আসার প্রকৃত চিত্র সহজে বুঝতে পারেন তাই তিনি এই বিষয়টি সামনে এনেছেন বলে এক মন্তব্যে জানিয়েছেন। পরিকল্পিত অস্ত্র মোদি ওয়েভে ভর করে আবারো ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে বিজেপি। তাই- ভারতের আগামী নির্বাচনে কোনো সারপ্রাইজ নেই বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বে এ যাবত কালের সর্বোচ্চ উগ্র মৌলবাদী দেশ ভারত। কোনো মৌলবাদী দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্থান কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।