নির্বাচিত কলাম
সা ম্প্র তি ক প্রসঙ্গ
ঢাকাবাসীর দুর্গতি শেষ হবে কবে?
তারিক চয়ন
৩ জুলাই ২০২২, রবিবারগত মাসেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডে ন্যূনতম একটি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি জানান, যে সব জায়গায় গণপরিসর ও মানুষের আনাগোনা বেশি সে সব স্থানে পর্যাপ্ত গণশৌচাগার নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭৫টি ওয়ার্ডে ন্যূনতম একটি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে এবং পরবর্তীতে জরিপ করে চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। মেয়র তাপসের এমন ঘোষণাকে স্বাগতম। কিন্তু, শুধু গণশৌচাগার নির্মাণ নয়, সেগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তোলাটাও সময়ের দাবি।
গত বছর একটি অদ্ভুত খবর অনেকের দৃষ্টি কেড়েছিল- রাশিয়ার দিকে ফিরে মূত্রত্যাগ করলে নরওয়ের মানুষকে জরিমানা গুনতে হবে! উত্তর-পূর্ব নরওয়ের জ্যাকবসেলভা নদীর ওপারেই রাশিয়া। এপার থেকে ওপার সহজেই চোখে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ কিংবা এর সীমান্তে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপরাধ করা নরওয়ের আইনে নিষিদ্ধ হলেও দেশটির অনেক মানুষই রাশিয়ার দিকে ফিরে মূত্রত্যাগ করে থাকেন। সীমান্তবর্তী সেই নদীতে নরওয়েবাসীর মূত্রত্যাগের বিষয়ে দেশটির সরকারের কাছে রাশিয়া কখনো অভিযোগ না জানালেও গত বছর নদীর তীরে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে লিখে দেয়া হয় ‘রাশিয়ার দিকে ফিরে মূত্রত্যাগ করা যাবে না। করলে কড়া জরিমানা।’ বিশ্বজুড়ে উন্মুক্ত স্থানে মূত্রত্যাগের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। কিন্তু, এসব নিয়ে খুব কম খবরই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যতক্ষণ না খবরগুলো অদ্ভূত কিংবা চমকপ্রদ হয়। ঠিক এরকমই একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে সাত বছর আগে।
মূত্রত্যাগের জন্য রোনালদোকে ভর্ৎসনা জানানো হয় এবং ধমকও দেয় পুলিশ। তবে, পুলিশের ধমক খেয়ে মোটেও বাড়াবাড়ি করেননি তিনি। বরং, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পায়ে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। শুধু রোনালদো কেন, বিভিন্ন সময় রাস্তায় মূত্রত্যাগ করে বিপাকে পড়তে হয়েছে নানান দেশের, নানান জগতের তারকাকেই। বছর পাঁচেক আগে রাস্তায় মূত্রত্যাগ করে বিপাকে পড়তে হয়েছিল প্রতিবেশী ভারতের দুই মন্ত্রীকে। ২০১৭ সালের জুন মাসে দেশটির কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহের বিশেষ মুহূর্তের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তাতে দেখা যায়, প্রকাশ্যে মূত্রত্যাগ করছেন রাধামোহন সিংহ আর বন্দুক হাতে তাকে পাহারা দিচ্ছেন নিরাপত্তাকর্মীরা। ওই ঘটনার পর অনেকেই তার মন্ত্রিত্ব কেড়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। অনেকে অবশ্য মন্ত্রীর পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, এতেই প্রমাণিত হয় পরিষ্কার শৌচাগার নির্মাণে ভারত এখনো কতোটা পিছিয়ে। গণশৌচাগার থাকলে এমনটা ঘটতো না। কৃষিমন্ত্রী রাধামোহনের ওই ঘটনায় নরেন্দ্র মোদি সরকার অনেকটাই সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কারণ, ২০১৪ সালে ক্ষমতার মসনদে বসেই মোদি স্বচ্ছ ভারত অভিযান শুরু করে দেশব্যাপী লাখ লাখ শৌচাগার তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তাই, রাধামোহনের ঘটনার পর সরকারের সমালোচকরা বলতে শুরু করেন, মোদির অভিযানের প্রভাব ভারতের বেশির ভাগ জায়গায় খুব সামান্যই পড়েছে। সমালোচকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেই বুঝি কিছুদিন বাদে ফের রাস্তায় মূত্রত্যাগ করেন দেশটির আরেক মন্ত্রী! একই বছরের (২০১৭) নভেম্বরে মহারাষ্ট্রের মাঠে জল সংরক্ষণমন্ত্রী রাম শিনডের জলত্যাগের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায়। আত্মপক্ষ সমর্থন করে মন্ত্রী অবশ্য জানান, সেচ প্রকল্পের কাজ খতিয়ে দেখার জন্য মাসখানেক ধরে তাকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হচ্ছিল। প্রচণ্ড গরম ও ধুলোবালির মধ্যে ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পাশাপাশি জ্বরেও ভুগছিলেন। পথে রাস্তার ধারে কোথাও শৌচাগার না পেয়ে প্রকাশ্যেই মূত্রত্যাগ করতে বাধ্য হন। দুই মন্ত্রীর এমন কাণ্ডের পর প্রশ্ন উঠে, যেখানে নিজের মন্ত্রীরাই উচ্ছৃঙ্খল, সেখানে প্রধানমন্ত্রী কীভাবে আশা করেন যে, সাধারণ মানুষ শৃঙ্খলা মেনে চলবে? গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ঠিক ওই সময়েই ‘বিশ্ব শৌচাগার দিবস’ উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ৭০ কোটিরও বেশি মানুষ রাস্তায় মূত্রত্যাগ করেন এবং অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার ব্যবহার করেন। সে যাই হোক, ঠিক একই বছর (২০১৭) ভারতে মূত্রত্যাগ বিষয়ক একটি ভিন্নধর্মী খবর প্রকাশিত হয়- রাজধানী নয়াদিল্লির রাস্তায় মূত্রত্যাগে বাধা দেয়ায় অটোরিকশা চালককে পিটিয়ে হত্যা।
নিহত রবীন্দ্র কুমার একটি মেট্রো স্টেশনের পাশের রাস্তায় তার ই-রিকশা স্ট্যান্ডের কাছেই দুই তরুণকে মূত্রত্যাগ করতে দেখেছিলেন। তাদেরকে বাধা দিয়ে প্রতিবাদ করলে ক্ষেপে ওঠে ওই দুই তরুণ। কিছুক্ষণ পর ১২/১৩ জন মিলে রবীন্দ্রকে ধাতব রড এবং তোয়ালেতে পাথর ভরে টানা ২০ মিনিট পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়। ঘটনার সময় তাকে বাঁচাতে কেউই এগিয়ে আসেনি! মার খাওয়ার পর রবীন্দ্র বাসায় ফিরে গেলেও রাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় ভারতের প্রভাবশালী মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু ঘটনাটিকে ‘দুঃখজনক’ মন্তব্য করে জানান, ই-রিকশাচালক রবীন্দ্র সরকারের ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের পক্ষে কাজ করছিলেন। এসব ছাড়াও, বছর দুয়েক আগে মূত্রত্যাগ নিয়ে ভারতেই একটি মজার খবর প্রকাশিত হয়- খবরে জানা যায়, রাজ্যের প্রায় প্রতিটি দেয়ালে মূত্রত্যাগ করার প্রেক্ষিতে ব্যাঙ্গালুরু পৌরসভা এক অভিনব পন্থা নিয়েছে। এটা এমন এক পন্থা যাতে দেয়াল ভেজাতে এসে মূত্রত্যাগকারী লজ্জায় সরে পড়তে বাধ্য হয়। নিয়মিত মূত্রত্যাগ করা হয়, শহরের এমন পাঁচটি জায়গার দেয়ালে বিরাট বড় আকারের আয়না লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে ফলও মিলে। মূত্রত্যাগ করতে উদ্যত হয়ে অনেকে মুখ তুলে আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জায় কেটে পড়েন।
অতি সমপ্রতি বাংলাদেশেও জনৈক ব্যক্তির পদ্মা সেতুতে মূত্রত্যাগের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। নেটিজেনদের অনেকে যেমন ছবিটি নিয়ে হাস্যরস করছেন, তেমনি অনেকেই আবার তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়ছেন। প্রকাশ্যে এমনভাবে সেতুর উপর মূত্রত্যাগ যে চরম নিন্দনীয়, খারাপ কাজ তা নিয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। শুধুই ভাইরাল হওয়ার জন্য বা ‘অন্য কোনো উদ্দেশ্যে’ তিনি এমন কাজ করেছেন কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। আর শুধু কি পদ্মা সেতু? দেশের অন্যান্য সেতু, মহাসড়ক, মাঠ-ময়দান, দালানের দেয়াল এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানী ঢাকার ফুটপাথ তো বটেই, রাস্তার মাঝপথে পর্যন্ত মানুষকে মূত্রত্যাগ করতে দেখে আমরা তো অভ্যস্তই। এর একটি কারণ অবশ্যই অভ্যাস, তবে আরেকটি বড় কারণ গণশৌচাগারের অভাব। অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, মানুষ ফুটপাথে না হেঁটে রাস্তায় হাঁটেন কিংবা ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পার হন। কিন্তু, ঢাকা শহরের অধিকাংশ ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজের গোড়ায় যেভাবে মলমূত্র ত্যাগ করা থাকে, সাধারণ- নিরুপায় মানুষ করবেইটা বা কী! অনেক ব্যস্ত এলাকায় গণশৌচাগারের অভাবে অনেক অতি ভদ্রলোককেও একান্ত বাধ্য হয়ে খোলাস্থানে, ফুটপাথ কিংবা গাড়ি বা গাছের আড়ালে মূত্রত্যাগ করতে দেখা যায়।
কোটি কোটি মানুষের বিপরীতে হাতেগোনা যে কয়েকটি গণশৌচাগার রয়েছে সেগুলোও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়। আবার যে কয়েকটি পাওয়া যায় সেগুলোও নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর আর অনিরাপদ। গত মাসেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ডে ন্যূনতম একটি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি জানান, যে সব জায়গায় গণপরিসর ও মানুষের আনাগোনা বেশি সে সব স্থানে পর্যাপ্ত গণশৌচাগার নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৭৫টি ওয়ার্ডে ন্যূনতম একটি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে এবং পরবর্তীতে জরিপ করে চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। মেয়র তাপসের এমন ঘোষণাকে স্বাগতম। কিন্তু, শুধু গণশৌচাগার নির্মাণ নয়, সেগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তোলাটাও সময়ের দাবি।