ঢাকা, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ১৯৯৭ বাংলাদেশের জন্য অগ্নিপরীক্ষা -আত্মীকরণ না শাসন

ব্রি: জে: মোঃ নাসিমুল গনি, পিএইচডি, এমডব্লিউএস, এমডিএস, এএফডব্লিউ, পিএসসি (অব:)

(১ বছর আগে) ১ জুলাই ২০২২, শুক্রবার, ৭:৪২ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৭:৫৮ অপরাহ্ন

mzamin

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত এক দশমাংশ স্থান জুড়ে পাহাড়, নদী, উপত্যকা এবং প্রায় ১৩টি নৃতাত্বিক ছোট গোষ্ঠিদের বসবাসযোগ্য একটি অনিন্দ্য সুন্দর অঞ্চল। দীর্ঘ ২২ বৎসর (মতান্তরে আরও বেশি) ইন্সারজেন্সি অপারেশন চলার পর নৃতাত্বিক অধিবাসীদের নেতৃত্বদানকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং বাংলাদেশ সরকারের সমন্বয়কারী দলের নেতৃত্বের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ১৯৯৭ (শান্তিচুক্তি) নামে অভিহিত। দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর শান্তিচুক্তির আলোকে বিবিধ বিষয় বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার নানাবিধ বাস্তবায়নযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করে। দীর্ঘ এই সময়ে শান্তিচুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি/হয়েছে বলে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ রয়েছে। 

এ কথা সত্য যে শান্তিচুক্তি হলেও দীর্ঘ ২৫ বৎসরেও সেখানে প্রকৃতপক্ষে শান্তিচুক্তির সম্পূর্ণতা আসেনি। সম্প্রীতির বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপি) নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জিওসি ২৪ পদাতিক ডিভিশন (ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার এর আওতাধীনে বেসামরিক প্রশাসনকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তাকারী) শান্তিচুক্তি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এপি সমন্বয় সদর দপ্তর স্থাপন উদ্বোধন এবং আইন শৃঙ্খলা উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারের চিন্তার রূপরেখা এবং দায়িত্বের পরিধি উল্লেখ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সারজেন্সি ও কাউন্টার ইন্সারজেন্সির ইতিহাস বৃটিশ, পাকিস্তান এবং স্বাধীনতা উত্তর সরকারের সূদীর্ঘ সময়ের ইতিহাস ও কার্যক্রমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কালের পরিক্রমায় আজও বাংলাদেশ সরকারকে ২০২২ সালে এসে সময়, সম্পদ এবং মেধা ব্যয় করতে হচ্ছে এর স্থায়ী সমাধানের জন্য। 

কেন পার্বত্যবাসী এবং নেতৃত্ব বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশ এবং সংবিধানের আওতায় নিরাপদ নিশ্চিত জীবনের অধিকার সুনিশ্চিত নয় বলে ভীত? একটি প্রশ্ন নিশ্চয়ই জাগবে হঠাৎ করে এ নিয়ে সরব আলোচনা ও নীতি নির্ধারকদের চিন্তায় কি এমন পরিবর্তন এসেছে যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুন:মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হলো। আমার চিন্তার খোরাক বাস্তব তথ্য ও উপাত্ত এবং আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভূরাজনীতির পরিবর্তন (মানবজমিন ০২ মে ২০২২ এবং সংখ্যায় প্রকাশিত, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যায়- আমরা কি প্রস্তুত? এবং পিএইচডি থিসিস (২০১৫) “The Peace Accord of 1997 and impacts of the security situation of the region with reference to Bangladesh” - ব্রি: জে: মোঃ নাসিমুল গনি (অব:) এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়গুলো রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব, ছাত্র সমাজ, অসামরিক আমলা, বিভিন্ন পেশাজীবি ও সাধারণ মানুষের নিকট অতি গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখন্ডতার সাথে প্রত্যক্ষ ও নিবিড়ভাবে গ্রহিত একটি “জাতীয় সমস্যা” বলে চিহ্নিত হয়নি। 

১৯৭৬ সাল হলে মূলত: বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়টিকে উপলব্ধি, সমন্বয় এবং নীতিমালা নির্ধারণ করে সরকারকে নিয়মিত অবহিত করেছে (ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার এর আওতাধীনে)।

বিজ্ঞাপন
১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের কার্যক্রম, সংখ্যা, অপারেশন সীমিত করে ফেলে, ৪০০ অস্থায়ী নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পের (আর্মি, বিজিবি, পুলিশ এবং আনসার ও জিডিপি) মধ্যে ২৮৩ টি ক্যাম্প বন্ধ করে দেয় এবং অসামরিক প্রশাসন ক্রমান্বয়ে শান্তি শৃঙ্খলার দায়িত্ব নেয়। সীমিত পর্যায়ে ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার এর আওতাধীনে এখনও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম  চলমান রেখেছে। ইতোমধ্যে অসামরিক প্রশাসন (জেলা, পুলিশ ও বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এবং আঞ্চলিক পরিষদ) পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও আইন শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ সমন্বয় ও দায়িত্বভাব নিয়েছেন। আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতি হয়েছে কি না তা গত ২/৩ বৎসর জাতীয়, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ঘাটলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। 

সম্ভবত: আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্নয়ে খারাপ হয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকারকে এপি এর মত সুপ্রশিক্ষিত পুলিশকে সন্ত্রাস দমন ও আইন শৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য মোতায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। প্রশ্ন জাগে তা হলে কি বাংলাদেশ পুনরায় একটি কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে? অসামরিক প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বিধায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক অধিবাসীরা পুনরায় সরকারের সরব বিরোধীতা করছে এবং অস্ত্রের মাধ্যমে পুনরায় সমাধান চাচ্ছে? স্থানীয় পাহাড়ী অধিবাসীদের আদিবাসী স্বত্তা, জুম্মল্যান্ড ও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতির দাবী, বিশ্বমানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন এইড অব সিভিল পাওয়ার দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি, শান্তিচুক্তির ধারাসমূহ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে পাহাড়ী নেতৃত্ব ও জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, পার্বত্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে পার্বত্য আঞ্চলিক বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে চার ভাগে বিভক্তি, জাতীয় রাজনীতির প্রতি অনাস্থা, জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতি, ১৯৭৬ সাল ও তার পূর্বের বসতি বাঙালি সেটেলারদের সমতল ভূমিতে ফেরতের দাবী, জুম চাষের আধিক্যের কারণে প্রকৃতি, আবহাওয়া, ভূমিরূপ ও বনায়নে চরম অস্থিরতা, বিদেশী ও দেশীয় বিবিধ সংগঠনের সাথে আইন শৃঙ্খলা বিরোধী দলসমূহের সংযোগ, স্থানীয় ব্যবসায়ী, প্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও পেশাজীবিদের নিকট হতে আইন শৃঙ্খলা বিরোধী/সন্ত্রাসীদের নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা বিরোধীদের অস্ত্রসহ ক্যাম্প ও কার্যক্রম পরিচালনা, বিবিধ উৎস হতে অস্ত্রসংগ্রহ, প্রতিবেশী দেশের সন্ত্রাসীদের সাথে সংশ্লিষ্টতা ও সহায়তা, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক দলের মধ্যে অন্ত:দ্বন্ধ ও চাকমা নৃতাত্বিক শ্রেণির আধিপত্য, পাহাড় ও সমতল ভূমিতে অবস্থানরত কিছু বাঙালির অনৈতিক, আর্থিক এবং অপপ্রচারে অংশগ্রহণ, স্থানীয় অধিবাসীদের খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা, বিভিন্ন অভিযোগ যেমন অত্যাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি দ্বারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মানসিক ও নৈতিক চাপের মধ্যে রাখা, জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহের পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে নিস্পৃহতা ইতাদি বিষয়গুলো সরকার ও অসামরিক প্রশাসন কেন সমগ্র দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখেছে তা গভীরভাবে ভাবনা এবং সর্বস্তরে আলোচনার দাবী রাখে। জাতীয় স্বার্থের উর্দ্ধে কোন কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব যেখানে প্রথম হতে হুমকির সম্মুখীন সেখানে শুধুমাত্র এপিকে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মোতায়েন করা কখনও নিরাপত্তার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। 

জুম্মল্যান্ডদের ধারণাটি ১৯৭২/৭৩ সাল হতেই জন্ম হয়েছে। পিসিজেএসএস এর রাজনৈতিক শাখা ১৯৭২ সালে এবং শান্তি বাহিনী সামরিক শাখা হিসাবে ১৯৭৩ সালে গঠিত হয়। আমি পূর্ব ইতিহাসে যাব না। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি হলেও প্রকৃতপক্ষে সামরিক শাখা বিলুপ্তির কোন ঘোষণা পিজিসেএসএস দেয়নি। একই সাথে অস্ত্র ভান্ডারের মূল অংশ গোপনেই পিপিজেএসএস এর কাছে থেকে যায়। ফলশ্রুতিতে অস্ত্রভান্ডার এবং মত পার্থক্যের কারণে পিসিজেএসএস বা পাহাড়ী নেতৃত্ব বর্তমানে চারভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগের নিজস্ব অস্ত্রভান্ডার, ক্যাম্প, ক্যাডার, চাঁদার হার ভিন্ন। রাজনৈতিক দিক দিয়ে চারটি দল আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারে সমানভাবে ব্যস্ত। গত ২৫ বৎসরে জুম্মুল্যান্ডের বৈদেশিক শাখা বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নিকট নমনীয় শক্তিসমূহ ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে। ফলশ্রুতিতে ইউরোপীয়ান অর্থনৈতিক কমিশন, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান তাদের নৈতিকভাবে সাহায্য করা শুরু করেছে। তাতে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। 

ইন্টারনেটে http:/www.academia.edu এ রতন চাকমা, পিএইচডি কর্তৃক ইউটিউব ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে জুম্মুল্যান্ডদের সংবিধান http://m.facebook.com.groups, জম্মুল্যাদের পতাকা, সরকারী মনোগ্রাম, মানচিত্র, এনআইডি, রেডিও চ্যানেল, মুদ্রা, জুম্ম লিবারেশন আর্মি, জাতীয় সংগীত, জুম্মুল্যান্ড সরকার ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য প্রদান করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে করুণালস্কার ভান্তে(তথাকথিত পররাষ্ট্র মন্ত্রী) নামক একজন জেএসএসএর এক শীর্ষ নেতার সাক্ষাতকার প্রচারিত হয়। direthmalkikarach টুইটারে জুম্মুল্যান্ডের কথা প্রচার করছেন। বিদেশে বসবাসরত অনেক পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী এই প্রপাগান্ডা যুদ্ধে সামিল হয়েছে। আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুনাচল, দিল্লী, ব্যাঙ্গালুর ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসরত চাকমারা বিভিন্নভাবে এই কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা ও সমর্থন প্রদান করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জুম্মুল্যান্ডদের ঘোষিত সরকারের অফিস রয়েছে বলে জানা যায়। ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব চাকমা বিভিন্ন ফোরামে জুম্মুল্যান্ডের স্বপক্ষে তাদের সমর্থন দিচ্ছে। প্রীতি গ্রুপের প্রধান প্রীতি কুমার চাকমা ও তার কিছু সঙ্গী এখনও ভারত সরকারের আশ্রয়ে রয়েছেন। 

প্রয়াত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় আমৃত্যু পাকিস্তান সরকারের আনকূল্যে পেয়েছেন। ১০ নভেম্বর সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম নেতা এম এল লারমা হত্যা দিবস হওয়ায় জাতীয় শোক দিবস হিসাবে জুম্মুল্যান্ডদের পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহ ১৭ আগস্টকে “পার্বত্য চট্টগ্রাম আগ্রাসন দিবস”, ২০শে আগস্টকে “অভিশপ্ত দিবস বা কালো দিবস” হিসাবে পালন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপার পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা দাবী দাওয়া/মিছিল ইত্যাদি বের করেছে।

দেশের বামপন্থী রাজনীতিবিদদের আনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের দাবী দাওয়া ও বৈষ্যম্যের স্বপক্ষে নিজেদের অবস্থানকে তুলে ধরেন। অনেক সংস্কৃতি কর্মী লেখকরা এই বিষয়ে সহমত পোষণ করেন। আমি অবাক হয়ে গত ২৩ মে ২০২২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২০২৩ উপস্থাপনে দেখলাম কৃষি ও কৃষক স্বার্থ-সম্পর্কিত মীমাংসনীয় বিষয় হিসাবে প্যারা (২) এ কৃষি ভূমি, জলা সংস্কার বিভাগ গঠন করে আগামী বৎসরে ৪০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করে যার একটি অংশ হলো সেটেলার বাঙ্গালীদের (পার্বত্য চট্টগ্রাম বসবাসরত) সমতলে পুনর্বাসনে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাবনা। এ কথা সত্য যে, শান্তি চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশীদের এখন অনেকেই সচেতন এবং তাদের মতামত বিভিন্ন ফোরামে প্রকাশ করছেন।

 একই সাথে পিসিজেএসএস নেতা সন্তু লারমা বাংলাদেশের ছোট ছোট নৃতাত্বিক গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে “আদিবাসী ফোরাম” তৈরী করেছেন। তারা আদিবাসী চিন্তা চেতনাকে ধারণ করে তাদের অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য বিবিধ দাবি-দাওয়া দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট উপস্থাপন করছেন। একথা সত্য যে, এসব ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এখনও তারা অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ বিষয়ে সকল স্তরে সাধারণ জনগণ, সুধীজন এবং নীতি নির্ধারকদের বিস্তারিত চিন্তা-ভাবনার অবকাশ আছে। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে প্রশ্ন রাখতেই পারি যে সরকারের যে সুবিন্যস্ত অসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা রয়েছে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম উপরোক্ত বিষয়গুলোকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে এবং নিশ্চয়ই তারা সরকার ও দেশের স্বার্থে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, জাতীয় সংসদ, সংসদীয় কমিটি, এনজিও ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ইত্যাদিতে দায়িত্ববানরা পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত তথাকথিত জুম্মুল্যান্ডের জন্য দেশে ও বিদেশে প্রচারণা, প্রপাগান্ড, ষড়যন্ত্র, সহায়তা, বিশ্বাসঘাতকতা, অর্থ পাচার, রাষ্ট্রদ্রোহীতা, বিছিন্নতা, আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ, প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সে বিষয়গুলোর যথাযথ উপস্থাপনা প্রয়োজন। সরকারের সকল স্তরে বিষয়টি জানা থাকলে এবং মূল্যায়িত হলে তবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। 

সেক্ষেত্রে ইতিহাস বলে যে এপি ব্যাটালিয়ানের মোতায়নে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিতে খুব সহায়ক হবে না। কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনের মূলনীতি, প্রশিক্ষণ, মনোবল, অপারেশন পদ্ধতি ইত্যাদি মানা না হলে পরিস্থিতির আরো অবনতির সম্ভাবনা রয়েছে। ২৫ বৎসর পর যদি এ বিষয় নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্টরা সচেতন ও আত্ম-উপলব্ধি না করেন তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে দেশ ও জাতি অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে পারে। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা বলে যে কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশন কখনই শুধুমাত্র সামরিক শক্তি বা কঠিন শক্তি (Hard Power) ব্যবহার করে মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। এর সহযোগী শক্তি হিসাবে চাই নরম শক্তিসমূহের (Soft Power) অবিচ্ছেদ্য এবং মূল্যবান ব্যবহার। শুধুমাত্র দুই শক্তির সমন্বিত ব্যবহার, কৌশল এবং ধারাবাহিকতায় শুধুমাত্র আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান সম্ভব। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে বাংলাদেশের অখন্ডতা, মর্যাদা এবং উন্নয়নের গতিশীলতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। ইতিহাসের সাথে সহযোগীতা না করলে নৃতাত্বিক গোষ্ঠীসমূহ সময়ের বিবর্তনে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। 

পাহাড়ে বসবাসরত নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্য আমাদের ভাই ও বোন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে সমান সুযোগ ও অধিকার প্রদান করেছে। এই সুযোগকে হাতে কুক্ষীগত করার অবকাশ নাই। জাতির বৃহত্তর স্বার্থ পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় এর নামকরণ পরিবর্তন করত: “ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক মন্ত্রণালয়” নামকরণ আবশ্যক। একই সাথে নূতন এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য পরিধি সারা বাংলাদেশব্যাপী হওয়া দরকার। “আদিবাসী” শব্দ চয়নটি বাংলাদেশ সরকার যথাযথ এবং যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিধায় দেশ ও বিদেশের সংবাদ মাধ্যম, গবেষণাবিধ ও সুশীল সমাজ এবং কূটনৈতিক মহলে সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। একইভাবে শান্তি চুক্তির অমিমাংসিত বিষয়সমূহ বিশেষত: ভূমির মালিকানার দ্বন্দ্বটির সমাধান অতি জরুরী। এপি ব্যাটালিয়ানকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অজুহাতে মোতায়েন নৈতিক এবং পদ্ধতিগত কারণে পুন:বিবেচনা করার অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, বাঙালী এবং পাহাড়ী নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর যারা প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়েছেন এবং মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের অবদানকে কোনক্রমেই বিপন্ন/অবনত করা যাবে না। দেশ মাতৃকার এই ক্রান্তিলগ্নে সবাইকে একত্রে এবং একই উদ্দেশ্য কাজ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থে এবং বাংলাদেশের অষন্ডতা নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল সমূন্নত রাখা এবং তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের বিষয়টির স্পষ্টতা ও নিরবিচ্ছন্নতা রক্ষা আবশ্যক। আমার স্থির বিশ্বাস বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা আমাদেরকে সঠিক পথেই চলমান রাখবেন।

লেখক

ব্রি: জে: মোঃ নাসিমুল গনি, পিএইচডি, এমডব্লিউএস, এমডিএস, এএফডব্লিউ, পিএসসি (অব:) 

Email: [email protected]
 

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status