শেষের পাতা
তুলে নেয়ার পর কী ঘটেছে
মিজানুরের বিবরণ, পুলিশের অস্বীকার
মরিয়ম চম্পা
১৯ জুন ২০২২, রবিবারআলোচিত মুখ মিজানুর রহমান। জুরাইনের এই মিজান সরব জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা আন্দোলনে। গত ৯ই জুন জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন একটি মার্কেট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় শ্যামপুর থানায়। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। কীভাবে তাকে নেয়া হয় কী ঘটেছে তার সঙ্গে? মানবজমিনের কাছে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। ডিবি কার্যালয়ে দীর্ঘক্ষণ বুঝিয়েছেন কর্মকর্তারা। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
মিজানকে তুলে নেয়ার আগের দিন জুরাইনে একজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। মামলায় ৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪৫০ জনকে আসামি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় কথা বলার পাশাপাশি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে মিজান লেখেন, ‘দুটি ঘটনা ঘটবে বলা যায়। এক. মামলা বাণিজ্য। দুই. মামলার ভয় দেখিয়ে ঘুষ বাণিজ্য। এমন একটি রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে এ ঘটনার নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু তদন্ত চাইবো, সে অবস্থাও নেই।’
মিজানুর রহমান তার সঙ্গে ঘটা পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তার কথা- হঠাৎ করে এক পুলিশ অফিসার এসে জিজ্ঞেস করে আমার নাম মিজানুর রহমান কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ। তখন উনি বললেন, আমাদের সিনিয়রের সঙ্গে আপনার কথা বলতে হবে। পরক্ষণেই আমাকে শ্যামপুর থানায় নিয়ে যায়। সেখানে ওসির রুমে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করার শুরুতেই ওনারা খারাপ আচরণ শুরু করে। তুই-তুকারি। তারপর একপর্যায়ে গালিগালাজ। ওনারা যখন নানান কথাবার্তা বলছিল, তার একটি পর্যায়ে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন উনারা ক্ষেপে যায়। আমি যে গণমাধ্যমে কথা বলেছি সেই ভিডিওটা দেখিয়ে বলে, এই যে তুই এই কথা বলছোস না? আমি বললাম, হ্যাঁ অবশ্যই বলেছি। আমার কাছে ব্যাখ্যা আছে। আপনারা প্রয়োজনে তদন্ত করে দেখেন এটা সত্য কি মিথ্যা। এ রকম নানা প্রকার কথাবার্তার একপর্যায়ে আমার গায়ে হাত তোলে।
ঢাকা মহানগর ওয়ারী জোনের এক নারী সহকারী উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) বলেন, এই লাঠি নিয়ে আয়। ওনার নির্দেশেই মূলত আমার গায়ে হাত তোলে। এতে মানসিকভাবে আমি প্রচণ্ড ভেঙে পড়ি। রাগ হয়। ওই অবস্থায় তারা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে। পরক্ষণেই সিনিয়র কর্মকর্তা আসার আগে একজন বলে, আমি বিএনপি করি। বিএনপি’র কমিটিতে আমার নাম আছে। পরে বললাম যে, এই তথ্যটা ঠিক না। তথ্যটা যাচাই করে নিয়েন। আবার এক সময় বলছে, স্যার ওতো পরিবারশুদ্ধ আন্দোলন করে। ওখানে থাকা আরেকজন সিনিয়র বলছিল, ওর পরিবারশুদ্ধ তুলে নিয়ে আয়। কথাবার্তা শেষে একজন পুলিশ অফিসার এসে আমাকে কিছু ছবি দেখালো। বললো, ছবিতে থাকাদের আমি চিনি কিনা। একপর্যায়ে ওনারা আমাকে থানা হাজতে নিয়ে যায়। সেখানে ঘণ্টা খানেকের মতো রাখে। পুরোটা সময় দাঁড় করিয়ে রাখে। পরে আমাকে ডিবির কাছে তুলে দেয়। থানায় ঢোকানোর সময় পুলিশের যারা আমাকে হাজতে ঢুকাচ্ছিল তারা মজা করে কিছু কথা বলেছে।
তখন আমার মনে হয় পুলিশের মধ্যে আগেই কিছু আলোচনা ছিল। বলছে, আপনাকে তো অনেক দিন ধরে দেখার ইচ্ছা ছিল। আজকে দেখলাম। ভালো লাগলো। আপনার সবকিছু খারাপ লাগে। তবে একটা জিনিস ভালো লেগেছে। আমি বললাম, কি ভালো লাগছে ভাই? তখন বললো, ওয়াসার এমডিকে যে শরবত খাওয়াতে গিয়েছিলেন এই প্রতিবাদটা ভালো লাগছে। তখন বললাম, খারাপ লাগছে কোনগুলো? তখন বললো, এই যে আপনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেন। আমি বললাম, আমি একজন নাগরিক। একজন মানুষ। সরকার এবং রাষ্ট্রের যে সিস্টেম তার বিরুদ্ধে কথা বলবো না? বললো, এত কথা বইলেন না। বুঝবেন নে। ভেতরে গিয়ে দেখলাম আরো দু’জন তারাও একই অভিযোগে অভিযুক্ত। তারা বললো, ভাই আমি ছিলাম না। টেলিভিশনে কথা বলছি এজন্য ধরে নিয়ে আসছে।
ডিবিতে যখন নিয়ে আসে তখন আমাকে এবং পাশের জনকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে একসঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে আসে। একটি গাড়িতে করে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। এ সময় গাড়ির ভেতরে প্রায় ৭-৮ জন ডিবি সদস্য ছিল। তারা তাদের সারাদিনের ডিউটি নিয়ে সুখ-দুঃখের কথা বলছিলেন। এক সদস্য বললেন, মুরব্বি কেন যে এটা করতে গেলেন। সারা জীবন তো বাতের ব্যথায় ভুগবেন। এরপর ডিবি অফিসের দ্বিতীয়তলায় এক সিনিয়র অফিসারের রুমে আমাকে নিয়ে যায়। তখনও চোখ বাঁধা। একই হাতকড়া পরানো দু’জনের। ওখানে চোখ বাঁধা অবস্থায় আরও কিছু মানুষের কথা শুনি। তাদেরকে জেরা করছে। একটা পর্যায়ে আমাদের চোখ খুলে দেয়। সেখানে যে ছেলেদের দেখলাম তাদের কাউকে আমি চিনি না। সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে আমাকে একা রাখে। দীর্ঘক্ষণ আমার সঙ্গে আলাপ করে।
আমার নাম জানতে চায়। কি করি না করি বিস্তারিত জানতে চান। এরপর রুমে থাকা সিনিয়র গোয়েন্দা অফিসার নানারকম কথাবার্তা বলেন। কেন আমি প্রপার চ্যানেলে ঊর্ধ্বতনদের জানালাম না। সেটার আমি উত্তর দিলাম, কেন জানালাম না। তারা বার বার বলছিল, উনি না হলে আরেকজন বললেও কাজ হতো। রুট লেভেলে অনেক সময় আমরা অনেক তথ্য জানি না। আপনারা জানালে হয়তো কাজ করতে পারি। প্রপার চ্যানেলে কথা বললে ভালো হতো। কিন্তু আপনার এখানে কথা বলা তো উস্কানিমূলক হয়ে গেছে। আমি বললাম, না। এই ঘটনার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আমি ঘটনাস্থলে যাই। এবং এই কথা বলি আরও অনেকক্ষণ পরে। তারা বলে, না আপনার এই ঘটনার পর বিকালেও থানার দিকে লোকজন গেছে। আমি বলি, জানি না ঘটনা সত্য কিনা। একটা পর্যায়ে জিজ্ঞেস করছে, আমি আরও কি কি করি। পরিবেশ নিয়ে আমি কি কাজ করি। পরিবেশবাদী আমাকে বলা হয়। আমি বলি, পরিবেশবাদী কিনা জানি না। তবে পরিবেশ নিয়ে সাধ্যমতো কাজ করার চেষ্টা করি। এ সময় দেখলাম তার কাছে অনেক ফোন আসে। তখন জানতে চাওয়া হয়, আমার সঙ্গে এত মানুষের পরিচয় কীভাবে? আমি বললাম, নানারকম কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে। অনেক কথা বলার পর একটা সময়ে সিনিয়র ডিবি কর্মকর্তা বলেন, কেন এই ঝামেলার মধ্যে জড়াতে যান! ধরেন সরকারের বিরুদ্ধে কথাগুলো বলছেন।
যদি দু’একটা মামলার মধ্যে জড়িয়ে যান। সেই মামলার ভবিষ্যৎ কি বোঝেন? ধরেন কেউ একজন মানুষ আপনার পকেটের মধ্যে ইয়াবা গুঁজে দিয়ে একটা মামলা দিয়ে দিলো। মামলা যে দিলেন সে জানে যে আপনি নির্দোষ। ২০ বছর পর মামলার রায় হলো। এই ২০ বছরের জার্নিটা একবার চিন্তা করেন তো। মানুষের জীবনে এগুলো ফেস করা তো অনেক সমস্যা। এরমধ্যে আমার রাজনীতির ভিউ কি? জিজ্ঞেস করলো। আমি কি রাজনীতি করি? পরে আমি বলতে চাইলাম, আমি শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। এবং প্রতিটি মানুষ যেন মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারে। ওনারা কথাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য কথায় চলে গেলেন। এরপর দেখলাম আমাদের এলাকায় সংসদ সদস্য ওনাদের রুমে গেলেন। তখন আমাকে পাশের রুমে ডেকে নিয়ে গেল। পাশের রুমে বসলাম। সেখানে থাকা এক গোয়েন্দা সদস্য আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এর আগে পুরোটা সময় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারা বসতে দেয়নি। অনেক কথাবার্তা বলার পরে গলাটা শুকিয়ে গেছে। বললাম, একটু পানি খাওয়া যাবে? উনি বললেন যে, না রোজা রাখেন। আমি আর কিছু বললাম না। কথাবার্তা বলার পরে উনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বললেন, একসময় আমরাও ছাত্র রাজনীতি, লড়াই-সংগ্রাম করেছি।
নানারকম ভাঙচুর করেছি। তারপর আমাকে বললেন, আপনার মধ্যে হিরোইজম কাজ করছে। হিরোইজম কি দরকার? আমাদের এমপি সাহেব বের হয়ে যাবে এ সময় আমাকে সিনিয়রের রুমে নেয়া হলো। ওখানে কিছুক্ষণ বসে থাকি। এ সময় আমাকে কফি দেয়। পানি চাই। পানিও দেয়। এর মধ্যে আমাকে জিজ্ঞেস করে খাওয়া-দাওয়া করেছি কিনা। বলেছি, না দুপুরে খাওয়া হয়নি। তিনি বললেন, ওনার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো। ভাত আর কফি খেলাম। সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, তিনি মনে করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধানতম মনোযোগ পাওয়া উচিত কৃষি খাতে। বললাম কেন? তিনি বললেন, যদি আপনার খাদ্য নিরাপত্তাই না থাকে তাহলে এতকিছু দিয়ে কি করবেন। এখন চারদিকে যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে খাদ্যটাই আসল। আপনার আর পুলিশের মধ্যে যা ঘটছে এগুলো যদি না বলেন তাহলে সবার জন্য ভালো হয়।
এরপর বললো, আপনাকে আমরা কার জিম্মায় দিবো। আমি আমার সন্তান আর স্ত্রীর কথা বললাম। ওনারা ফোন দিলেন। ফোন দেয়ার সময় আমার মেয়ে ভয় পেয়ে ফোনটা রেকর্ড করে ফেলে। রেকর্ড করার কথা শুনে আমার খুব লজ্জা লাগলো। আমার জীবনে আমি কোনো গোপনীয়তা চর্চা করতে চাই না। আমার বাচ্চা এই কাজ করলো। আমি খুব লজ্জা পেলাম। কেননা আমাকে যা প্রশ্ন করা হয়েছে তার সবগুলোর উত্তর দিয়েছি। কোনোটি বাদ দেইনি। তখন আমার সন্তানের হয়ে ডিবি কর্মকর্তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করলাম। তিনি আমার বাচ্চাকে বললেন, ভ্যারি ব্যাড। ঠিক হয়নি কাজটা। আমরা তো জানতে পারছি আপনি রেকর্ড করছেন। স্ত্রী-সন্তান আসার পরে আমাকে পাশের রুমে নিয়ে যায়। এর আগে আমার কাছে মুচলেকাটা নিয়ে আসে। রাষ্ট্র এবং আইনবিরোধী কাজ করবো না এরকম কিছু একটা লেখা ছিল। যদিও আমি মনে মনে মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে চাচ্ছিলাম না। এ সময় আমার মেয়ে এবং স্ত্রীকে বলা হলো আমাকে যেন এ বিষয়ে তারা বোঝায়।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তাছাড়া মিজানুর নামে কাউকে গোয়েন্দা হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সেটাও আমার জানা নেই। শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফিজুল আলম বলেন, আমাদের এখানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় হওয়া মামলার বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে তাকে পুলিশ এবং পরবর্তীতে গোয়েন্দা হেফাজতে নেয়া হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় মুচলেকা নিয়ে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। থানা হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, থানা হেফাজতে তাকে কোনো নির্যাতন বা খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। বিষয়টি অতিরঞ্জিত এবং মিথ্যা।