ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাই

পুরো টাকা উদ্ধার নিয়ে যে শঙ্কা

শুভ্র দেব
২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার
mzamin

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ছিনতাই হওয়া ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকার পুরোটা উদ্ধার হবে কি হবে না- এ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। খোদ তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি’র একাধিক কর্মকর্তা এমন শঙ্কা দেখছেন। কারণ ছিনতাই করা টাকা ভাগবাটোয়ারা করে অনেক টাকাই ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন খাতে খরচ করেছে। এ ছাড়া, গ্রেপ্তার আকাশ আহমেদ বাবুল টাকা ভাগের সময় মানিপ্ল্যান্টের এক প্রকৌশলীর কথা বলে দেড় কোটি টাকা বেশি নিয়েছে। সেই টাকার হদিস মিলছে না। রিমান্ডে আসা আসামিদের অনেকেই জানিয়েছে, সেই টাকা আকাশ নিয়েছে। কিন্তু ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে আকাশ টাকার বিষয়টি অস্বীকার করছে। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, আকাশ পেশাদার অপরাধী। এর আগেও টাকা ছিনতাইয়ের একাধিক ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত। ধরা পড়ার ভয়ে আগে থেকেই ওই টাকা গোপন কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখেছে।

বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের কাছে ছিনতাই হওয়া টাকা আছে বলে ধারণা করছে ডিবি। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে টাকা উদ্ধারের পরিমাণ আরও বাড়বে। 

ডিবি’র মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ছিনতাইয়ের পর আমরা খুব গুরুত্বসহকারে মামলার তদন্ত করছি। খুব কম সময়ের ভেতরে আমরা আসামি গ্রেপ্তার ও ছিনতাই হওয়া টাকার বড় অংশই উদ্ধার করেছি। গত দুই দিনে ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা ও আগের ৭ কোটি ৮৯ লাখ ৬ হাজার এবং ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি নোহা মাইক্রোবাস উদ্ধার করেছি। সব মিলিয়ে ৮ কোটি ১৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া ১২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। বাকি টাকার মধ্যে বেশ কিছু টাকা তারা খরচ করেছে বলে আমাদেরকে জানিয়েছে। এ ছাড়া আরও দেড় কোটি টাকার বিষয়ে কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রেপ্তারকৃত অন্য আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ভাগবাটোয়ারার সময় আকাশ এক প্রকৌশলীকে দেয়ার কথা বলে দেড় কোটি টাকা বেশি নিয়েছে। কিন্তু আকাশ সেটি স্বীকার করছে না। আমরা আকাশকে নতুন করে আরও ৫ দিনের রিমান্ড চেয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই টাকা বের করার চেষ্টা করবো। তিনি বলেন, এ ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকজনকে আমরা গ্রেপ্তার করবো। তাদের কাছ থেকে আরও টাকা উদ্ধার হবে বলে ধারণা করছি। 

ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার ১২ জনের মধ্যে ৭ জনের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তারা ছিনতাই হওয়া টাকার ভাগবাটোয়ারার সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার সানোয়ার হাসানের কাছ থেকে ১ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। ডিবি ঢাকার বনানী থানা এলাকার ১৭ নম্বর রোডের ডি ব্লকের ৫ নম্বর বাড়ি থেকে ওই টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার ইমন ওরফে মিলনের কাছ থেকে ভাটারা থানার ১৪৫/১ জোয়ারসাহারা রোডের কামরুজ্জামান সেলিমের বাড়ি থেকে ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। দক্ষিণখানের নর্দাপাড়া ক্লাব মোড়ের নইমুদ্দিন রোডের বেলাল উদ্দিনের বাড়ি থেকে সাগর মাদবরের কাছ থেকে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার হৃদয়ের কাছ থেকে ৪৮ লাখ ৭ হাজার টাকা বনানীর কড়াইল বস্তির বউ বাজারের খামার গলির হাশেমের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার মিলন মিয়ার কাছ থেকে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানার নিজ গ্রাম পূর্ব বাকল জোড়া থেকে ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তার আকাশ আহমেদ বাবুলের কাছ থেকে খিলক্ষেত এলাকা থেকে ২০ লাখ টাকা মূল্যের নোহা গাড়ি ও সোহেল রানার কাছ থেকে পল্লবী ও ঢাকা জেলার সাভার থেকে  ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ ছিনতাইকারীদের তথ্যমতে আরও ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার হয়। ডিবি সূত্র বলছে, গ্রেপ্তার ১২ জনের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ৯ জন। তারা হলেন- সানোয়ার হাসান, ইমন ওরফে মিলন, আকাশ মাদবর, সাগর মাদবর, বদরুল আলম, মিজানুর রহমান, সোনাই মিয়া, মো. হৃদয়, লিমন মিয়া, আকাশ আহমেদ বাবুল ও সোহেল রানা। আর জবানবন্দি দেয়ার বাকি আছে আকাশ আহমেদ বাবুল, সোহেল রানা ও এনামুল হক বাদশা।

তদন্ত সূত্র বলছে, ডাচ্- বাংলা ব্যাংকের টাকা মানিপ্ল্যান্টের গাড়ি থেকে ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনা করে সোহেল রানা। মূল পরিকল্পনায় আকাশ ও হাবিব ছিল। এদের মধ্যে সোহেল রানা এক সময় মানি প্ল্যান্ট লিংক কোম্পানির গাড়িচালক ছিল। গাড়িচালক থাকার কারণে কোম্পানির টাকা আনা-নেয়ার খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে জানতো। ওই সময় লুট করা গাড়ির নকল চাবিও বানিয়েছিল। তার কাছ থেকে মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির একটি আইডি কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। সোহেল রানা জানতো মানি প্ল্যান্ট কোনো সিকিউরিটি ছাড়াই টাকা বহন করে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। সে এই পরিকল্পনাটি শেয়ার করে আকাশ ও হাবিবের কাছে। তিন জন একমত হওয়ার পরে আকাশ প্ল্যানটি বনানীর ১৮ নম্বর রোডের স্পা সেন্টারের কর্মী ইমন মিলনের সঙ্গে শেয়ার করে। ইমন মিলন তখন সানোয়ারকে বলে এই কাজের জন্য কিছু সিম ও বাটন মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার জন্য বলে। কথামতোই সানোয়ার সিম ও মোবাইল সেট সংগ্রহ করে। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বদরুল, সোনাই, মিজান, বাদশা ও হিমনের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে রাজি করায়। যদিও বাদশা ছিনতাইয়ে অংশ নেয়নি। বদরুল আবার কিছু ওয়ানটাইম ছিনতাইকারী সংগ্রহের কাজ করে। সে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের আনছারকে বলে একটা কাজের জন্য তার এলাকার কিছু লোক দরকার। আনছার তখন ঢাকায় বসবাসরত তাহিরপুর এলাকার হৃদয়, মিলন, জনি, মোস্তফাকে রাজি করায়। অন্যদিকে সোহেল রানা নিজে রেন্ট-এ কারে যোগাযোগ করে সিলেট যাওয়ার জন্য একটি কালো মাইক্রোবাস ভাড়া করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকেই ঘটনার ২ দিন আগে ঢাকায় একত্রিত হয়। মূল পরিকল্পনাকারীরা তাদেরকে ঢাকায় এনে নতুন কাপড় ও জুতা কিনে দেয়। ভাড়া করা মাইক্রোবাসের চালক আকাশ মাদবরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সোহেল রানা। তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালের দিকে ঘটনার দিন ভোরবেলা আসতে বলে। আকাশ সময়মতো গাড়ি নিয়ে আসার পর ছিনতাইকারীরা তার হাত-পা বেঁধে গাড়ির পেছনে ফেলে রেখে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেয়। 
ডিবি জানায়, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা মিরপুরে গিয়ে মানি প্ল্যান্টের টাকা বহনকারী গাড়িকে অনুসরণ করতে থাকে। পরে তুরাগ এলাকায় যাওয়ার পর ছিনতাই করা টাকার ট্রাঙ্ক গাড়িতে ওঠায়। ছিনতাইয়ের পর ধস্তাধস্তির সময় গাড়িতে উঠতে পারেনি মূল পরিকল্পনাকারী আকাশ। গাড়িতে ওঠার আগেই তার সহযোগীরা গাড়ি টান দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে আসে। তুরাগ থেকে ঘুরে গাড়িটি আবার মিরপুর এলাকায় আসে। মিরপুর এলাকায় সোনাই, মিজান, হৃদয় গাড়ি থেকে নেমে যায়। যারা গাড়িতে ছিল তারা ট্রাঙ্কের থেকে টাকা বের করে বস্তা ও ব্যাগে ভরে নেয়। এদের মধ্যে সানোয়ার ও বদরুল ২ ব্যাগ টাকা নিয়ে বনানী চলে যায়। মিলন ও মোস্তফা ২ বস্তা টাকা নিয়ে কড়াইল চলে যায়। আর হাবিব ও রানা তিন ব্যাগ টাকা নিয়ে যায়। পরিকল্পনাকারী আকাশের জন্য এক ব্যাগ টাকা তারা গাড়িতেই রেখে যায়। বস্তা ও ব্যাগ না থাকার কারণে ট্রাঙ্কে থাকা সব টাকা তারা নিতে পারে নাই। কারণ তাদের ধারণা ছিল সর্বোচ্চ ৫/৬ কোটি টাকা গাড়িতে থাকতে পারে। তাই সেই অনুপাতেই তারা সঙ্গে করে ব্যাগ-বস্তা নিয়ে যায়। চালক আকাশ পরে গাড়িতে থাকা ব্যাগটি নিয়ে তার ছোট ভাইকে দিয়ে দেয়। 

ডিবি জানায়, আকাশ এবং সোহেল রানা অন্যদের কাছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা লুটের বিষয়টি গোপন রাখে। তারা তাদেরকে জানায়, তারা কিছু অবৈধ হুন্ডির টাকা লুট করবে এবং সেখানে প্রশাসনের লোক থাকবে। পরে ঘটনার দিন সবাই কুর্মিটোলায় একত্রিত হয়ে মাইক্রোবাসে ওঠার পর বুঝতে পারে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ডাকাতির পর মূল হোতা আকাশ মাইক্রোবাসে উঠতে না পারায় অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা ধারণা করে  আকাশ ধরা পড়ে গেছে। ধরা পড়ার ভয়ে তারা তাদের কাছে থাকা অপারেশনাল মোবাইল ফোন ও সিমগুলো ৩০০ ফিটে ফেলে দেয়। তাই তারা ট্র্যাঙ্ক ভেঙে টাকা লুট করতে তাড়াহুড়ো করে। পরে তারা ৩০০ ফিটের একটি নির্জন জায়গায় গিয়ে ব্যাগ এবং বস্তায় করে যার যার মতো টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status