শেষের পাতা
ডিবেট পর ডেমোক্রেসি’র অনুষ্ঠানে মতিউর রহমান চৌধুরী
ভূ-রাজনীতির খেলায় যেন আমরা পা না দেই
স্টাফ রিপোর্টার
১১ মে ২০২৫, রবিবার
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সিনিয়র সাংবাদিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। বলেছেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে, এটা হোক। এ নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমাদের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভূ-রাজনীতিতে একটা খেলা চলছে। আমরা যেন মনের অজান্তে সেই খেলায় পা না দেই। শনিবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণ বিষয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি অয়োজিত ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) অনুষ্ঠিত ওই আয়োজনে বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকাতে করণীয় নির্ধারণে ঢাকায় একটি সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান করতে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতি প্রস্তাব রাখেন। বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেশিদিন চললে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের রাজনীতিতে, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমি আহ্বান জানাই প্রফেসর ইউনূসের প্রতি, তিনি যেন সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন।
মতিউর রহমান চৌধুরী আরও বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যমেই দেখেছি যে, ভারতে সামনে দুটো নির্বাচন আছে। বিহার ও পশ্চিববঙ্গে। রাজনৈতিক দিক থেকে ওই দুটি নির্বাচন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য চ্যালেঞ্জ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানকেও রক্ষা করতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিন্তু নির্বাচিত নন। ইমরান খান এখন জেলে। তার এই যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ইমরান খানের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও ফয়সালা হয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী সামনের কাতারে চলে আসছে। পাকিস্তানের জনগণ এখন কী বলবে? তারা বলবে, দেশরক্ষা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী। সেজন্য দুইদিকেই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। রাজনীতি বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক কারণ লেখা যাবে না। আর ইতিহাস লিখতে হলে রাজনীতি থাকবে। পুশ ইন চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুশ ইনকে বাধা দিতে গিয়ে আমরা এমন কোনো কাণ্ড না ঘটাই যেটা সামাল দিতে পারবো না।
যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি খানিকটা টালমাটাল উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেয়ারবাজার কলাপস্ করেছে। আমদানিতে বিরাট চাপ। আমাদের সামনে একটা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এমনিতেই আছে। আরেকটা তৈরি হতে যাচ্ছে। ইস্টার্ন ফ্রন্টে কিন্তু যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এখানে চীন একটা ফ্যাক্টর। ‘সাতকন্যা’র দিকে কিন্তু চীনের নজর রয়েছে। ভূ-রাজনীতিতে এটার প্রভাব অনেক থাকবে। এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কাশ্মীরকে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাশ্মীর না থাকলে পাকিস্তানের নেতৃত্ব এবং ভারতের নেতৃত্বের ফয়সালা হবে না। ’৪৭-এ ভাগ হয়েছে, তারপরও কেন বিরোধ? সরকার বদলায় এই যুদ্ধের কারণে। আগামীতেও তাই হবে। মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ভুয়া সংবাদের কারণে যেকোনো সময়, যেকোনো সিদ্ধান্তে আমাদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভুয়া খবর থেকে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক যারা সিদ্ধান্ত নেন, তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। দল নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত। তারা এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কিন্তু জাতিকে টাইম টু টাইম জানাতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। এরমধ্যেই আমাদের খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে- আমাদের কথা বলা, আচার-আচরণ থেকে সব কিছুতে। যাতে আমাদের গায়ে কোনো আঁচড় না লাগে। যে আঁচড় থেকে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার-আপনার একটা বক্তব্য কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে আমরা পাকিস্তানের দিকে নজর দিচ্ছি, সম্পর্ক গড়ছি। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, ভারত আমাদেরকে বৈরী মনে করে। প্রতিপক্ষ মনে করে। ভারতের সঙ্গেও আমরা সুসম্পর্ক চাই। পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক চাই। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দেনা-পাওনার বিষয়টিও আসছে। ভারতের অনেক সিদ্ধান্ত আমরা অপছন্দ করি। কিন্তু লক্ষণীয়- ভারতের যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সব রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি কথা বলেছেন। তার আগের ঘটনা হচ্ছে কংগ্রেস বলেছে, তিনদিন আগেই অর্থাৎ ১৯শে এপ্রিল তিনি জানতেন, পহেলগামে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।
নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না, সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি সেনাবাহিনীর ওপর। এটা কি আসল কথা? না এটা আসল কথা না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেনাবাহিনী যুদ্ধ শুরু করে না। বক্তব্যের পর মানবজমিন প্রধান সম্পাদক বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটকে আপনি কীভাবে দেখেন? তিনি বলেন, টানাপোড়েন চলছে। দুই দেশের মধ্যে শব্দের লড়াই হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়নি, বাণিজ্য আছে। ভারত বরাবরই একঝুড়িতে আম রাখার চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া তারা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাননি। সম্পর্ক রেখেছে, কিন্তু যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটা কমাতে তারা চেষ্টা করেনি। তিনি বলেন, আমরা জানি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এটা ১৯৭১ সাল থেকে। এই সম্পর্ক বজায় থাকুক, এতে আপত্তি নেই। কিন্তু ভারত এমন আচরণ করছে যেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো পার্টিকে নেই। এটা ঠিক হয়নি। এখন তাদের নিশ্চই উপলব্ধি হয়েছে বা হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এতটা খারাপ নয় উল্লেখ তিনি বলেন, তাহলে কিন্তু তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকার করতো না। নরেন্দ্র মোদি-প্রফেসর ইউনূসের মধ্যে বৈঠক হতো না। সম্পর্ক আছে, তিক্ততা আছে। এই সম্পর্কের উন্নতি হওয়া উচিত অবিলম্বে। সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ৬ই মে মধ্যরাতে পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যে সকল মসজিদ ধ্বংস হয়েছে সেই সব মসজিদেই ঐদিন পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ব্ল্যাক আউটের মধ্যেই সংহতি প্রকাশের জন্য ফজরের ওয়াক্তে একত্রিত হয়েছিল পুরো এলাকার বাসিন্দারা।
এই পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কোনো উস্কানিতেই মুসলিম-হিন্দুর যুদ্ধ হিসেবে বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না। তবে বিজিপি সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করে ভারতীয় মুসলমানদের স্বস্তি প্রদান করা উচিত। তাই এই দুই দেশে অবস্থানকারী মুসলমান ও হিন্দুরা যার যার অবস্থান থেকে ধর্মীয় উত্তেজনা পরিহার করে এই যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। তা না হলে বিশ্ব এই দুই পারমাণবিক শক্তির সংঘাতের ভার বইতে পারবে না। ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মূল কারণ রাজনৈতিক নয় ঐতিহাসিক’ শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বিতার্কিকগণ অংশগ্রহণ করেন। এতে জয়লাভ করেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বিতার্কিকরা। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান, সাংবাদিক মাঈনুল আলম, ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক এ কে এম মঈনুদ্দিন, কবি ও সাংবাদিক জাহানারা পারভিন। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।