ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকি বাড়ছে ৭ জনের মৃত্যু

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার

দেশে এবছর নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১০ জন। যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়ে গত ৪ বছরের মধ্যে রেকর্ড। দেশের সব জেলা এখন নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। শীতের মৌসুম শুরু থেকেই গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস। এ সময়ে মানুষের মধ্যেও খেজুরের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম একটি প্রিয় খাবার। আর বাদুড়ে মুখ দেয়া খেজুরের রস পানে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

বিজ্ঞাপন
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই রোগের কোনো টিকা নেই। এটার কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসাও নেই। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর তথ্য মতে, দেশের সব জেলা এখন নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, আমরা নিপাহ ভাইরাসের সার্ভিলেন্সে জোর দিয়েছি। যখন যেখানেই নতুন কেস হচ্ছে, আমরা খবরটা পেয়ে যাচ্ছি। ভাইরাসটিতে এখন পর্যন্ত ১০ জন শনাক্ত হয়েছে, এর মধ্যে ৭ জনই মারা গেছেন। ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কেউ যদি বেঁচেও যান তার নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আমরা যদি শুধু খেজুরের রস খাওয়াটা বন্ধ করে দিতে পারি তাহলেই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকতে পারি। সতর্কতা অবলম্বন করে রস খাওয়া যাবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকেই বলেন, আমরা সাবধানতা অবলম্বন করে রস সংগ্রহ করছি। এটা আসলে ভুল। আপনি যতই জাল দিয়ে ঢেকে রাখেন, এতে আক্রান্তের সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ শুধু রসে বাদুড় মুখ দিলেই নিপাহ ভাইরাস হয় না, বাদুড়ের ইউরিন থেকেও নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে থাকে।

আইইডিসিআর তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত ২২ বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে ৩২৫ জনের দেহে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৩০ জন মারা গেছেন। আইইডিসিআর বলছে, দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে হয় নওগাঁয়। তবে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় আকারের প্রাদুর্ভাব হয় ফরিদপুর জেলায়, ২০০৪ সালে। সে বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে ২৭ জনের মারা যায়। এ ঘটনার পরপরই আইইডিসিআর এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি’) সম্মিলিতভাবে এ ঘটনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নামে। তখন এতে অর্থসংস্থান করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। আইইডিসিআরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত ২২ বছরে ৩৩টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে।

অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, নিপাহ ভাইরাস আক্রান্তের অন্যতম কারণ খেজুরের কাঁচা রস। এ ছাড়াও আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে হয়। এ ছাড়াও পাখি বা বাদুড়ের অর্ধ খাওয়া যেকোনো ফলমূল খেলেও হয়। তাই কাঁচা খেজুর রসের পাশাপাশি যেকোনো পাখির অর্ধ বা আংশিক খাওয়া ফলমূল থেকেও বিরত থাকতে হবে। অনেক সময় গাছের নিচে বিভিন্ন পাকা ফলমূল পড়ে থাকে, বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় এটি বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এই বিষয়গুলোতে আমাদের সচেতন হতে হবে। এ ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণটি খুবই মারাত্মক। বলা হয়ে থাকে, নিপাহ ভাইরাসে ৭০ শতাংশেরও বেশি মৃত্যু হয়। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত যাদেরই আক্রান্ত হতে দেখেছি, প্রত্যেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রতিবছর দেশে নিপাতে অনেক আক্রান্ত হয়, এমনটি নয়। কিন্তু যারাই আক্রান্ত হয়, তারাই মারা যায়। তবে, মৃত্যুর কাছ থেকে যারা ফিরে আসেন, তাদের জন্য এক ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করে। বেঁচে থেকেও তারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে। অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বলেন, এই রোগের কোনো টিকা নেই। এটার কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসাও নেই। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট। যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিনেই তার চিকিৎসা চলবে।

আইইডিসিআর এটি নিয়ে কাজ করছে। একার পক্ষে তো মানুষকে সচেতন করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণায় গণমাধ্যমকেও আরও ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, সচেতনতার জায়গা থেকে সবাইকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। কেউ কাঁচা খেজুরের রস খেতে চাইলে তাকে বাঁধা দিতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), আইসিডিডিআর,বি’সহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, গা ব্যথা, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যাওয়া, বমিবমি ভাব এবং গলাব্যথা হতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকা শুরু করতে পারে। এধরনের রোগী আলো সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

গত ১১ই জানুয়ারি নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বছরের প্রথম এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় আইইডিসিআর। ভাইরাসে মৃত নারীর বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। খেজুরের রস খেয়ে তিনি বাদুড় বাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর আগে গত বছরও (২০২২) নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের তিনটি কেস পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন। এদের একজন ছিলেন নওগাঁর, অন্যজন ফরিদপুরের। আইইডিসিআর আরও জানায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাই কাঁচা খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, বাদুড় যখন খেজুরের রস খায়, তখন তার দ্বারা সেটি ‘ইনফেকটেড’ হয়ে যায়। মানুষ সেই রস কাঁচা খেলে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তারপর আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিতরা আক্রান্ত হয়। তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারেন।

লক্ষণ প্রসঙ্গে সংস্থাটি আরও জানায়, দূষিত খেজুরের রস খাওয়ার পর নিপাহ আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দিতে ৮ থেকে ৯ দিন লাগতে পারে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেয় ৬ থেকে ১১ দিন পর। নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ২০১১ সালে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় নির্দেশিকা জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশিকায় খেজুরের কাঁচা রসকে নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহন হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ রোধ করতে খেজুরের কাঁচা রস খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status