শেষের পাতা
বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছেই
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
৮ ডিসেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবারনানা উদ্যোগে আমদানি ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমলেও দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। আমদানিতে যে পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে তারচেয়ে রপ্তানি আয় কম হচ্ছে। ফলে অর্থবছরের শুরু থেকেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৫৯ কো?টি ডলার। একই সময় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতিও ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত দুটি কারণে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। প্রথমত, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের মধ্যে রপ্তানি আয় মোটামুটি ভালো থাকলেও রেমিট্যান্স বা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে পাঠানো অর্থের প্রবাহে ধীরগতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের ছাড় কমে গেছে। দুয়ে মিলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ কয়েক মাস ধরে লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি আনার তৎপরতা বাড়িয়েছে। তাদের মতে, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ২ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ৯৫৮ কোটি ৭০ লাখ (৯.৫৮ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ১ লাখ আড়াই হাজার কোটি টাকা।
অক্টোবর মাস শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৯৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ৪৩৩ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩৬ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৩৮৩ কোটি ডলার।
দেশে প্রায় এক বছর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার প্রবণতার মূল কারণ হলো- বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্তত ৬ মাস ধরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতি ডলার কিনতে এখন আমদানিকারকদের ১০৫ থেকে ১১০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এ পরিসংখ্যান বলছে, আমদানি ব্যয় ওই চার মাসে কমেনি। তবে বেড়েছে মাত্র ৬.৭২ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ৩৬ শতাংশ। ফলে আমদানির ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমানো গেছে। অন্যদিকে ওই চার মাসে রপ্তানি বেড়েছে ৮ শতাংশ। কিন্তু গত অর্থবছরে বেড়েছিল ৩৩ শতাংশ। যদি রপ্তানিতে আরেকটি বেশি প্রবৃদ্ধি থাকতো এবং আমদানি গত অর্থবছরের মতোই থাকতো, তাহলে চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে যেত। আবার গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে যায় ১৫ শতাংশ। এই চার মাসে তা ২ শতাংশের মতো বেড়েছে।
সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। অক্টোবর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮৭ কোটি ডলার। এই সূচকটি আগের বছর একই সময় ১৩৪ কোটি ডলার ঘাট?তি ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৭১৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন ৭০৫ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
এদিকে আলোচিত দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থায় নেমেছে। অর্থবছরে প্রথম চার মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ২ কোটি ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানা গেছে ঠিকই। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ইউরোপ-আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও কমতে শুরু করেছে। যদিও নভেম্বরে বেশ বেড়েছে। সেটি আগামী দিনগুলোতে বজায় থাকবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। একই সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেও বেশ ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বাড়ছে। মনে হচ্ছে, গত অর্থবছরের মতো এবারও বড় ঘাটতি নিয়েই অর্থবছর শেষ হবে।