শেষের পাতা
জলবায়ু পরিবর্তন কনফারেন্সে ক্ষতিপূরণ আসছে এজেন্ডায়
মানবজমিন ডেস্ক
১২ অক্টোবর ২০২২, বুধবারআগামী মাসে মিশরে হতে যাচ্ছে জাতিসংঘের ২৭তম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কনফারেন্স বা সিওপি২৭। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণের ইস্যুটি এজেন্ডায় নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন গ্রিস্ট একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশের সুমি আকতারের প্রসঙ্গ দিয়ে প্রতিবেদন শুরু করা হয়েছে।
ম্যাগাজিনটি লিখেছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় সুমি আকতার। তার সামনে দুটি পথ খোলা। একটি হলো হয়তো বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে তাদের গ্রামের বাড়িতে থেকে যাওয়া। না হয় বাড়ি থেকে ৫ ঘণ্টার দূরত্বে উত্তরপূর্ব দিকে রাজধানী ঢাকা। বাড়িতে তার স্বামীর কোনো কাজ নেই। যদি বাড়ি ছেড়ে যান, তাহলে তার পরিবারকে পিছনে ফেলে যেতে হবে। রাজধানী ঢাকা তার কাছে এমন এক জায়গা, যা কখনো দেখেননি। কিন্তু যদি তিনি বাড়ি থেকে যান, তাহলে তিনি ও তার দুই মেয়ের জীবনে নেমে আসবে অর্থনৈতিক অশান্তি।
সুমি আকতারের বাড়ি খুলনার নাসিরপুরে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে। মাঝে মাঝেই সমুদ্রের জোয়ারের সময় এই নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। লবণাক্ত পানিতে ভাসিয়ে দেয় কৃষিজমি, বাড়িঘর। শৈশবে সুমি আকতার দেখেছেন ঘূর্ণিঝড় কীভাবে নাসিরপুরের কাঁচা বাড়িগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। সুমি আকতারের ডাকনাম বীথি। তার পিতা জমিতে ধান, পাট, সবজি চাষ করতেন। কিন্তু তা ধুয়ে নিয়ে যেতো সাগরের পানি।
এমনি করে বছর যেতে থাকে। হিমালয় থেকে বরফগলা পানি নেমে আসায় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন নাসিরপুরের বাসিন্দারা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিপর্যয় কৃষকদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তারা নির্ভরশীল মূলত মিঠা পানির প্রবাহের ওপর। এ অবস্থায় ২০১৮ সালে বীথি ভাবতে থাকেন তিনি কি করবেন। ততদিনে কাজের সন্ধানে গ্রামের অনেক মানুষ চলে গেছেন বড় বড় শহরে। ফলে ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা কমতে শুরু হয়। এক গবেষণায় দেখা যায় ওই এলাকার প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে ৫.৫ জন অভিবাসী হয়েছেন। এলাকা ছেড়েছেন।
এ অবস্থায় বীথি তার অপশন নিয়ে ভাবতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ ডিজঅ্যাস্টার প্রিপেয়ার্ডনেস সেন্টারে পৌঁছেন। সেখানে ফ্রন্টডেস্কে একজন স্টাফের সঙ্গে কথা বলেন। এই সেন্টার জলবায়ু বিষয়ক কর্মসূচি পালন করে অন্য একটি বেসরকারি সংগঠন হেলভিতাস বাংলাদেশ-এর সঙ্গে। উভয়েই কাজ করে দুর্যোগের ঝুঁকি কমাতে। এজন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এবং স্থানীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজ করে। তারা বীথিকে তৃতীয় একটি বিকল্পের সন্ধান দিলেন, যা তিনি তখনও ভাবেননি। তাকে বললেন, একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে। হেলভিতাস তিন মাসের জন্য বিউটিশিয়ান প্রশিক্ষণ কোর্স করতে বীথিকে অর্থ দিতে চায়। তারপর তিনি নিজের মতো করে একটি বিউটি সেলুন চালু করতে পারবেন। বীথি কখনো ঘরের বাইরে কাজ করেননি। তবে এমন ধারণা তার পছন্দ হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আসতে হয়। যেমন তার পরিবার রক্ষণশীল। তাদের কাছ থেকে অনুমতি আনতে হয়। এক লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিতে হয়। তিনি পরিবারকে বোঝান যে, এই কাজের মাধ্যমে তিনি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবেন। তিনটি গ্রুপ তাকে এই ঋণ দিতে রাজি হয়।
ব্যস বীথি শুরু করে দেন তার বিউটি পার্লার। এখন তিনি নিজের সেই বিউটি সেলুনের নাম দিয়েছেন বৈশাখী বিউটি পার্লার। বড় মেয়ের নামে এই নামকরণ করেছেন। যেখানে পার্লার, তা নাসিরপুর থেকে ১০ মিনিটের পথ। এরই মধ্যে তিনি প্রায় পুরো ঋণ শোধ করেছেন। এখন সেলুনের ব্যাপ্তি বাড়াতে চাইছেন। একদিন তিনি একটি বিউটি স্কুল চালু করতে চান।
তিনি গ্রিস্টকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুম-এ বলেছেন, কখনো কল্পনা করিনি আজকের এই অবস্থায় আসতে পারবো। আমার জীবনে এমনটা ঘটবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। কল্পনা করিনি যে, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারবো, জীবন এভাবে পাল্টে ফেলতে পারবো।
বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ আছেন বীথির মতো। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীবনধারা পাল্টে ফেলেছেন। শিল্পপূর্ব সময় থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর ফলে ঘূর্ণিঝড়, তাপদাহ, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ত্বরান্বিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে যেসব দেশ, তারা দাবি করেছে তাদের মোট সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ হারিয়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অঝোরধারায় বৃষ্টিপাতের ফলে। এসব ঘটেছে গত ২০ বছরে। মানুষ হারিয়েছে জীবন-জীবিকা। হয়েছে বাস্তুচ্যুত। আরও বলা যায়, এর ফলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো। এসব দেশে পরে শিল্পায়ন হয়েছে। তারা বৈশ্বিক উষ্ণতায় অবদান রেখেছে সামান্যই। ওয়ার্ল্ড মেটেওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের মতে, ১৯৭০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা গেছেন কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে শতকরা কমপক্ষে ৯০ ভাগই উন্নয়নশীল দেশের।