ঢাকা, ১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

খেলা

স্কুল ক্রিকেটে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ বনাম বাংলাদেশ

ইশতিয়াক পারভেজ, ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কা থেকে
১১ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার
mzamin

শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে স্টেডিয়ামে বসে স্থানীয় দুই সাংবাদিকের কথোপকথন শুনছিলাম। তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ ও ঢাকা। সিংহলি ভাষা পুরোপুরি না বুঝলেও, বারবার বাংলাদেশ আর ঢাকার নাম উঠে আসছিল। একপর্যায়ে এক সাংবাদিক ছুটে এসে জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত? উত্তরে তাকে ঢাকার জনসংখ্যাও বললাম, তার মুখে ফুটে উঠলো বিজয়ের হাসি। মনে হলো, হয়তো তার বন্ধুর সঙ্গে এ নিয়েই বাজি ধরেছিলেন। এরপর তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘তোমাদের রাজধানীতে যত মানুষ, তা তো গোটা শ্রীলঙ্কার জনসংখ্যার সমান! তাহলে তোমাদের এত অভাব কেন ক্রিকেটারের?’ এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিল না। এরই মধ্যে জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুর কণ্ঠেও সেই হতাশার সুর শোনা গেল। দলের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের হাতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে লড়াই করার মতো খেলোয়াড়ের স্বল্পতা আছে। হয়তো ৩০ জন খেলোয়াড়কে ঘিরেই সবকিছু হচ্ছে। আমাদের হাতে মোট যে অল্প সংখ্যক খেলোয়াড় আছে, তারাই আন্তর্জাতিক মঞ্চে লড়াই করতে পারে।’ ১৭ কোটির বাংলাদেশে পাইপলাইনে এত কম ক্রিকেটার কেন থাকবে, যেখানে মাত্র ২ কোটির দেশ শ্রীলঙ্কা একের পর এক তারকা ক্রিকেটার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে এবং পাইপলাইনেও ক্রিকেটারের অভাব নেই। দুই দেশের এই হতাশার রহস্যটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন লঙ্কান সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক রেক্স ডি সুজা। তিনি বলেন, ‘স্কুল ক্রিকেটেই দুই দেশের বড় পার্থক্য।’ হ্যাঁ, শ্রীলঙ্কার স্কুল ক্রিকেটে যে কর্মকাণ্ড হয়, তা পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটেও হয় না!

ক্রিকেট বিশ্বে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ- উভয়ই প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি করছে। কিন্তু যখন ক্রিকেটের মূল ভিত্তি এবং কাঠামোগত দিকের কথা আসে, তখন শ্রীলঙ্কা তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং সুসংগঠিত ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। বিশেষ করে স্কুল ক্রিকেট এবং ক্রিকেট অবকাঠামোতে এই পার্থক্যগুলো স্পষ্ট। লঙ্কার স্কুল ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়, এটি তাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য দেশের ক্রিকেটের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। ১৮৮০ সাল থেকে চলে আসা কলম্বোর রয়্যাল কলেজ ও সেন্ট থমাস কলেজের ‘ব্যাটল অব ব্লুস’ বিশ্বের প্রাচীনতম স্কুল ডার্বিগুলোর একটি, যা আজও প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহ্য প্রমাণ করে, স্কুল পর্যায় থেকেই শ্রীলঙ্কায় ক্রিকেটের বীজ বপন করা হয়। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড এবং শ্রীলঙ্কা স্কুল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৬৭০টি স্কুল খেলে, যেখানে বছরে ৬,৮০০টিরও বেশি ম্যাচ আয়োজিত হয় বিভিন্ন বয়স-ভিত্তিক স্তরে (অনূর্ধ্ব-১৩, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯)। এই ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থেকেই অর্জুনা রানাতুঙ্গা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, মাহেলা জয়াবর্ধনে, কুমার সাঙ্গাকারা, বা সম্প্রতি ভানুকা রাজাপাকসে, চারিথ আসালাঙ্কা, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার মতো তারকা ক্রিকেটাররা উঠে এসেছেন। ‘অবজারভার স্কুলবয় ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেশটির তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য একটি স্বপ্ন, যা তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের ভিত্তি স্থাপন করে। স্কুল পর্যায়ে এমন উচ্চ মানের প্রতিযোগিতা এবং মেধা অন্বেষণের একটি প্রতিষ্ঠিত কাঠামো শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিভাবান খেলোয়াড় উপহার দিচ্ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশেও স্কুল ক্রিকেট বিদ্যমান, কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো সুসংগঠিত এবং কার্যকর মেধা অন্বেষণ প্রক্রিয়া এখানে এখনও গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে হাতেগোনা কিছু স্কুল ক্রিকেট খেললেও, এর পরিধি শ্রীলঙ্কার তুলনায় খুবই সীমিত। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা শত শত স্কুলকে এক ছাতার নিচে এনে একটি সুসংগঠিত লীগ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘাটতি রয়েছে। ফলস্বরূপ, জাতীয় পর্যায়ের জন্য পর্যাপ্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করার কাজটি এখানে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যেমন বিসিবি স্কুল ক্রিকেট, এটি এখনও শ্রীলঙ্কার সমকক্ষ হতে পারেনি।

শুধু স্কুল ক্রিকেটই নয়, দুই দেশের ক্রিকেট অবকাঠামোতেও বিশাল পার্থক্য। ক্রিকেট খেলার জন্য উন্নত স্টেডিয়াম, ভালো মানের উইকেট, অনুশীলন সুবিধাসহ অবকাঠামো অত্যন্ত জরুরি। এখানেও শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। শ্রীলঙ্কায় মোট ৮টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ রয়েছে যা নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করে। এর মধ্যে ৭টি মাঠই টেস্ট ভেন্যু। রাজধানী কলম্বোতেই তিনটি টেস্ট ভেন্যু, ক্যান্ডিতে দুটি এবং গলে একটি। এছাড়াও, ডাম্বুলা ও হাম্বানটোটায় আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম রয়েছে। এই স্টেডিয়ামগুলোর আধুনিক সুযোগ-সুবিধা এবং নিয়মিত ম্যাচ আয়োজনের সুযোগ শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক মানের পিচে খেলার অভ্যাস তৈরি করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করে এমন মাঠের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ঢাকা (শেরেবাংলা ও ফতুল্লা), চট্টগ্রাম (জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম), সিলেট (সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম) এবং খুলনার (শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম) মতো শহরগুলোতে আন্তর্জাতিক ভেন্যু রয়েছে, তবে সংখ্যার দিক থেকে এটি শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম। বিশেষ করে টেস্ট ভেন্যুর সংখ্যা এবং বিভিন্ন শহরে সেগুলোর বিস্তার শ্রীলঙ্কার মতো নয়। কক্সবাজারে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম থাকলেও, সেখানে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন সীমিত। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও সাফল্যের সাক্ষী। ১৯৮১ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ জয়, একাধিক আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে অংশগ্রহণ (২০০৭ ও ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) এবং শিরোপা জয় (২০০২ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ৬টি এশিয়া কাপ) তাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়ী মানসিকতা গড়ে তুলেছে। এই ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা তাদের কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে খেলার অনুপ্রেরণা যোগায়।
 

খেলা থেকে আরও পড়ুন

খেলা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status