ঢাকা, ৩০ জুন ২০২৫, সোমবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৩ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

শেষের পাতা

হরিপুরের চোরাই রাজ্যের শীর্ষ ১০ কারবারি জেলে

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে
৩০ জুন ২০২৫, সোমবার

তিন মাস পর আত্মসমর্পণ করলেন সিলেটের হরিপুরের চোরাই সিন্ডিকেটের ১০ সদস্য। গতকাল রোববার তারা সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। এর আগে অবশ্য তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশে ছয় সপ্তাহের জামিনে ছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল গত ২৭শে মার্চ। রমজানের ঈদের তিনদিন আগে। সীমান্ত গড়িয়ে দেশে আসা চোরাই পণ্যের অন্যতম বাজার ছিল হরিপুর। পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বারবার অভিযান চালালেও কোনো কাজ হয়নি। ঘটনার দিন টহলে থাকা সেনাবাহিনীর একটি জিপ গাড়িকে চাপা দেয় হরিপুরের চোরাকারবারিদের মহিষ বহনকারী একটি ডিআই পিকআপ গাড়ি। এরপর সেনা সদস্যরা ওই পিকআপকে ধাওয়া করে হরিপুরের পশুর হাট এলাকায় এসে গাড়িটির খোঁজ পান। সেনা সদস্যরা ওই গাড়ির মালিক, ড্রাইভার এবং পশুর মালিকের সন্ধানকালে উপস্থিত থাকা ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর হামলা করে। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ছুড়ে উপস্থিত সেনা সদস্যের ওপর। এতে কয়েকজন সেনা সদস্য আহত হন। ঘটনায় গুরুতর আহত একজনকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে হয়েছে। 

এ ঘটনার পর হরিপুরে অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। অভিযানে তছনছ হয়ে গেছে বাজার। চোরাই রাজ্যের সিন্ডিকেটরা গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দেন। কেউ কেউ পালিয়ে যান পার্শ্ববর্তী ভারতে। অনেকেই পালান ঢাকায়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তরফ থেকে বাজারের নিয়ন্ত্রক সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যানসহ ৭০ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ধরা পড়েনি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঘটনার মূলহোতা হরিপুর বাজারের সাবেক সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ ও উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক ওরফে সুইট ফারুক। ঘটনার সময় তাদের নেতৃত্বেই হামলার ঘটনা ঘটে। সেনা সদস্যের ওপর হামলার ঘটনার পর হরিপুরের পশুর হাট উচ্ছেদ করা ছাড়াও বাজারে সড়ক ও জনপথের জমি উদ্ধার করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা চোরাই চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে বাড়ি বাড়িও তল্লাশি চালান। এদিকে, পলাতক থাকা অবস্থায় হরিপুরের শীর্ষ ১২ জন কারবারি উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন নেন। রোববার ছিল তাদের জামিনের শেষ দিন। সকালে ১২ জনের মধ্যে ১০ জন আদালতে এসে হাজির হলে তাদের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবী নিজাম উদ্দিন। 

তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্ত আসামি ফতেহপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যান, হরিপুর বাজারের সাবেক সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক ফারুক ওরফে সুইট ফারুক, ফতেহপুর ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আজিউর রহমান, বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল মুতালিব, ফখরুল ইসলাম, ইসমাইল হোসেন, আমির উদ্দিন, জহির উদ্দিন, রশিদ চেয়ারম্যানের ছেলে মাসুক আহমদ। তারা সকালে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে হাজির হন। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে প্রেরণ করেছেন। মামলার আসামি পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট লুৎফুল কিবরিয়া শামীম জানিয়েছেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিনপ্রাপ্ত নাজিম উদ্দিন ও শাহীন আহমদ আদালতে হাজির হননি। যে ১০ জন হাজির হয়েছেন, তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। যারা হাজির হননি তাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবেন। 

বদলে গেছে হরিপুর: সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি বাজার হরিপুর। ধর্মীয় অনুশাসনের একটি এলাকা। অনেক আগে থেকেই ওই এলাকার লোকজন ভারত থেকে আসা চোরাই পণ্যের ব্যবসা করেন। কিন্তু কখনোই তারা বাজারের ওপর কলঙ্ক পড়তে দেননি। গত ৭-৮ বছর ধরে প্রকাশ্যেই গোটা বাজারকে চোরাই রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয়। প্রথমে তারা বাজারের ভেতরে চোরাই পশুর হাট বসান। এই হাটকে কেন্দ্র করে হরিপুরের এলাকাবাসীর দু’পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের রমজানেও দু’পক্ষের সংঘর্ষে এক মাওলানা নিহত হন। বাজারে চোরাই পণ্য ধরতে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি’র পক্ষ থেকে যতবারই অভিযান চালানো হয়েছে তাদের ওপর হামলা হয়েছে। ২০২০ সালের দিকে ভারতীয় চিনি সিন্ডিকেটের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে পরিণত হয় হরিপুর। তখন পশুর হাট থেকে চোখ সরিয়ে নেন অনেকেই। মেতে ওঠেন চিনি নিয়ে। ব্যবসায়ীদের মতে, হরিপুর থেকে কোনো কোনো দিন ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকার চিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হয়েছে। চিনির গোডাউন ছিল হরিপুর। সিলেট সীমান্তের যে রুট দিয়ে চিনি প্রবেশ করতো সবই চলে আসতো হরিপুরে। ওখান থেকে ট্রাকযোগে সেগুলো পৌঁছে দেয়া হতো দেশের বিভিন্ন স্থানে। ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পথে পথে চিনির গাড়ির ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা পিছু হটেন। রমজান থেকে শুরু হয় ভারতীয় পশুর হাটের প্রস্তুতি। কিন্তু এ ঘটনার কারণে এখন বাজার সম্পূর্ণ নীরব। কোনো চোরাই কারবার হয় না বাজারে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘটনার জন্য ঘটনাকারীদের ওপর এলাকার সবাই ক্ষুব্ধ। তারা কয়েক দফা বৈঠক করে মূল ঘটনাকারী ৭-৮ জনকে পুলিশে আত্মসমর্পণের অনুরোধ করলেও তারা সেটি করেনি। এ নিয়ে চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এলাকায়ও ক্ষোভ বেড়েছে। হরিপুর যাতে আর চোরাই রাজ্য হিসেবে পরিচিতি না পায়, সেজন্য স্থানীয়রাও চোরাই পণ্যের বিরুদ্ধে নেমেছেন। এজন্য চোরাকারবারিরা এখন গোয়াইনঘাটের রাধানগর, তোয়াকুল, জৈন্তাপুরের সদর বাজার, দরবস্ত, চিকনাগুল, কানাইঘাটের গাছবাড়ি, সড়কের বাজারকে চোরাই পশুর হাট হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব এলাকা দিয়ে ভারত থেকে নেমে আসা চোরাই পণ্য হরিপুরের দিকে না এনে সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধি সহ স্থানীয়রা।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status