শেষের পাতা
অনিয়মে সেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া নার্সিং ইনস্টিটিউট, নকলে পরীক্ষার সুযোগ
স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
৩০ জুন ২০২৫, সোমবারনিয়মিত ক্লাস ফাঁকি শিক্ষকদের। হাজিরা খাতাতে সিগনেচার করেই বেতন উঠিয়ে নেন। আর শিক্ষার্থীরা পেয়েছেন বই খুলে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ। আশ্চর্যজনক হলেও বছরের পর বছর এভাবেই চলে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নার্সিং ইনস্টিটিউট। নার্সিং প্রফেশনের পরীক্ষায় নকলের সুযোগ না থাকলেও সেটিই নিয়মে পরিণত করা হয়েছে এখানে। আরও নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দেশের ৪৯টি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজের মধ্যে ব্যতিক্রম করে তুলেছে এই নার্সিং ইনস্টিটিউটকে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শাখায় ৩৫৮ জন শিক্ষার্থীর এই প্রতিষ্ঠানে একজন ইনস্ট্রাকটর ইনচার্জ এবং ৮ জন প্রশিক্ষক রয়েছেন। অভিযোগ মিলেছে- ইনস্ট্রাকটরদের মধ্যে অনেকেই ইনস্টিটিউটে আসেন না মাসের পর মাস। কেউ কেউ আছেন নার্সিংয়ের কয়টি বিষয় সেটিও ঠিকভাবে বলার মতো সক্ষম নন। এমনও আছেন যে রিডিংও পড়তে পারেন না।
ইনস্ট্র্রাকটরদের মধ্যে নানা অভিযোগে আলোচিত মোশারফ হোসেন, তার স্ত্রী তানজিনা খানম, মোসাম্মৎ তাহেরা বেগম ও মোহছেনা বেগম (১)। মোশারফ হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া নার্সিং ইনস্টিটিউটের একজন ইনস্ট্রাকটর হয়েও তিতাস নার্সিং কলেজ নামে একটি বেসরকারি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং লাইফকেয়ার নামে আরেকটি শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটে চাকরির চেয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানেই ব্যস্ত তিনি। মোশারফ হোসেন ২০১৬ সালের ২রা মার্চ থেকে এই ইনস্টিটিউটে রয়েছেন।
অন্য ৩ ইনস্ট্রাকটর মোশারফের স্ত্রী তানজিনা খানম, মোসাম্মৎ তাহেরা বেগম ও মোহছেনা বেগম (১) এর বিরুদ্ধে আছে ক্লাস না করার অভিযোগ। ২০১৩ সালের ২১শে আগস্ট থেকে ডেপুটেশনে এই ইনস্টিটিউটে ইনস্ট্রাকটর হিসেবে রয়েছেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স তানজিনা খানম ও ২০২৩ সালের ৪ঠা মে থেকে মোসাম্মৎ তাহেরা এবং বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মোহছেনা বেগম (১) এখানে ডেপুটেশনে রয়েছেন ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি থেকে। মূলত মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বেই এই ইনস্টিটিউট অনিয়মের আখড়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শহরে মোশারফের মালিকানাধীন বহুতল বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থেকে ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত ছাত্ররা। ইনস্টিটিউট কব্জায় রাখতে তাদের ব্যবহার করে বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে কারণে যারা ইনস্টিটিউটকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফেরাতে গেছেন তারাই পড়েছেন বিপদে। সালাহউদ্দিন মাতবর নামের এক ইনস্ট্রাকটর ইনচার্জকে নানাভাবে হেনস্থা করে বিদায় করার অভিযোগ আলোচিত এই চক্রটির বিরুদ্ধে। ২০২৪ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর এখান থেকে বদলি হয়ে যান তিনি। তার পরবর্তীতে আসা নতুন ইন্সট্রাকটর ইনচার্জ মোসাম্মৎ মিরন্নাহার বেগমও রয়েছেন আতঙ্কে। ওই বছরের ১২ই সেপ্টেম্বর তার যোগদানের পরই তার কাছে আগের নিয়মে অর্থাৎ নকল করে পরীক্ষা দেয়ার দাবি তোলেন ৩য়বর্ষের শিক্ষার্থীরা। ইনচার্জকে জানায়, ফার্স্ট ইয়ারে অনেক পড়াশুনা করেছি। এরপর নকলের কথা শুনে পড়াশুনার হাল ছেড়ে দেই। পরীক্ষায় অবজেকটিভের উত্তর ইনস্ট্রাকটররা বলে দেন। রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেয়া বই দেখে। নকলমুক্ত পরীক্ষা হলেও পরীক্ষার সময় ইনস্টিটিউটে ৩০ জন করে লোক নিয়োগ দেয়া হয় নকল সরবরাহের জন্য। এই তথ্য পেয়ে অবাক হন নতুন ইনচার্জ। ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও তিতাস নার্সিং কলেজ, ইউনাইটেড নার্সিং কলেজসহ বেসরকারি ৩টি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা কেন্দ্র এটি। তাদের সঙ্গেও নকল করে পরীক্ষা পাসের ব্যাপারে রফাদফা হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তবে নতুন ইনচার্জ অনড় থাকায় এবার স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হন তারা। ছুটির ক্ষেত্রেও নিয়মের বালাই নেই এই ইনস্টিটিউটে। বছরে ২৮ দিন ছুটির স্থলে ৩ মাসও কাটিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী।
বর্তমান ইনস্ট্রাকটর ইনচার্জ মোসাম্মৎ মিরন্নাহার বেগম এখানে যোগদান করার পর এবছরের ১৬ই জানুয়ারি এবং ২২শে জুন দু’টি অফিস আদেশ করেন। যাতে নার্সিং ইনস্ট্রাকটরদের অফিস সময় সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অফিসে উপস্থিত থেকে রুটিন অনুযায়ী ক্লাস, ল্যাব এবং হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস পরিদর্শনসহ অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে বলা হয়। কিন্তু পরিবর্তন ঘটেনি।
মোশারফ হোসেন তার বিরুদ্ধে উঠা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বলেন- এটি আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা আমি অস্বীকার করবো না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাসিং ইনস্টিটিউট ইনস্ট্রাকটর ইনচার্জ মোসাম্মৎ মিরন্নাহার বেগম বলেন, একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম চলছে এখানে। অনিয়মকেই এখানে নিয়ম বানানো হয়েছে। শিক্ষকরা ক্লাসে আগ্রহী নন। অনিয়মগুলো কীভাবে দূর করা যায় সে ব্যাপারে শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করি। সেপ্টেম্বরে যোগদানের পর ৩ মাস সময় দিয়ে বলি নতুন বছর থেকে আমরা নতুনভাবে চলবো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের ক্লাসে পাঠাতে পারিনি।