প্রথম পাতা
ঋণ পরিশোধের চাপ রিজার্ভে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৬ জুন ২০২৫, বৃহস্পতিবার
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েই চলেছে। যত দিন যাচ্ছে ততই এই চাপ আরও বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল বাবদ অর্থ পরিশোধ ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারকে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওদিকে রেমিট্যান্সের রেকর্ড প্রবাহ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে অর্থ ছাড়ের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ বেড়েছে। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৩১ বিলিয়ন ডলার। ধীরে ধীরে রিজার্ভ বেড়ে এখন অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরার আভাস দিচ্ছে। তবে গত কয়েক মাস ধরে রির্জাভ ২৫-২৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই ওঠা-নামা করছে। কারণ বিদেশি ঋণ আর রপ্তানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে রিজার্ভের হ্রাস আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধকল থেকে রেব হতে পারছে না বাংলাদেশ।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক থেকে অর্থ পাওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স মোটামুটি ভালো হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলতি অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও গ্রেস পিরিয়ড শেষে এই চাপ আরও বাড়তে পারে। আর সংশ্লিষ্টদের মতে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে দেশীয় অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে সরকার প্রতি বছর বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে শর্তযুক্ত ঋণ নিচ্ছে। প্রতি মাসে এসব ঋণের একটি অংশ সুদ-আসলসহ পরিশোধও করা হচ্ছে। এদিকে পুরোনো প্রতিশ্রুত ঋণছাড়ের গতি নিয়েও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। অন্যদিকে আগের চুক্তিভিত্তিক ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ায় পরিশোধের দায়ও বাড়ছে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধে রেকর্ড: অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একটি হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অনুকূলে বিদেশি ঋণের যে পরিমাণ ছাড় হচ্ছে, তার একটি বড় অংশ পুরোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। কার্যত প্রতিশ্রুত ঋণ যতটুকু আসছে, তার বেশির ভাগ চলে যাচ্ছে আগের ঋণ শোধে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে, তার ৬৭ শতাংশই খরচ হয়েছে আগের ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে।
ইআরডি সর্বশেষ তথ্যমতে, এই সময় বাংলাদেশ ৫৬০ কোটি ৮১ লাখ ডলার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে। তবে সেখান থেকে ফেরত দিতে হয়েছে ৩৭৮ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, যার পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ৬৭৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। এই পরিশোধের মধ্যে সুদের অংশ ১৬ হাজার ৯১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা, আর মূল ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৮ হাজার ৭৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই- মে সময়ে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছিল ৩৩ হাজার ৮৯৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক ঋণ এবং এর সুদ বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে; আর এই চাপ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। একদিকে উন্নয়ন প্রকল্পে নেয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে, অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে। একইসঙ্গে বেশকিছু মেগা প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় সেগুলোর কিস্তি পরিশোধের সময় এসেছে। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে সরকারের ওপর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
ঋণ আসছে কম: চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মে) প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে ৫৬০ কোটি ৮১ লাখ ডলার পেয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। এর মধ্যে ঋণ বাবদ ছাড় হয়েছে ৫২২ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার, আর অনুদান এসেছে মাত্র ৩৭ কোটি ৯৫ লাখ ডলার।
ঋণ প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও একই ধারা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মোট প্রতিশ্রুতি এসেছে ৫৪৮ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ৭৯২ কোটি ৮৬ লাখ ডলার, কমেছে প্রায় ৩১ শতাংশ।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত সময়ে নেয়া বড় বড় মেগা প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে হওয়ায় বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়বে আরও ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারেরও বেশি। পর্যায়ক্রমে এ ঋণ পরিশোধের চাপ সামনের বছরগুলোয় আরও বাড়বে। কেননা, গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশি ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তা ছাড়া প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের চাপও সামনে বাড়তে থাকবে।
রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে যাবে: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বুধবার এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) বাজেট সহায়তার ৪০ কোটি ডলার যোগ হওয়ায় বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২২.৬৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে তা এখন ২৭.৬৭ বিলিয়ন ডলার। কয়েক দিনের মধ্যে রিজার্ভ আরও বাড়বে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, আইএমএফের ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভে যোগ হবে। সব মিলিয়ে জুন মাসের মধ্যেই বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছবে। গ্রস হিসাবে ৩০ বিলিয়ন ডলার হবে। এ ছাড়া জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) কাছ থেকে ৪০ কোটি ডলারের বেশি বাজেট সহায়তা পাওয়ার কথা রয়েছে। ১০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দিচ্ছে ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট। এ দুটি ঋণও জুনের মধ্যেই পাওয়া কথা রয়েছে।
জুনে মিলছে আরও বাজেট সহায়তা: চলতি মাসের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৩৫০ কোটি (৩.৫০ বিলিয়ন) ডলারের বাজেট সহায়তা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯০ কোটি ডলার দিচ্ছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ৫০ কোটি ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছ থেকে পাওয়া যাবে ৪০ কোটি ডলার। জাপান সরকার দিচ্ছে ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ওপেক ফান্ডের কাছ থেকে মিলছে ১০ কোটি ডলার। আইএমএফ’র ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের দুই কিস্তির (চতুর্থ ও পঞ্চম) ১৩০ কোটি (১.৩ বিলিয়ন) ডলারও যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ছয় উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে ৩৬২ কোটি (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বড় অঙ্কের ঋণের সবই চলতি জুন মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ৩০শে জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৪-২৫ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে মোট ৪ হাজার ৪৯৪ কোটি ৬০ লাখ (৪৪.৯৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ২ হাজার ৭৫০ কোটি (২৭.৫০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮.৬৯ শতাংশ বেশি।