প্রথম পাতা
জাপা’র অন্দরে কী হচ্ছে?
পিয়াস সরকার
২৫ জুন ২০২৫, বুধবার
ফের আলোচনায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় থাকা জাপা’র অন্দরমহলে চলছে নানা তৎপরতা। দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্ব চালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দলের একটি অংশ বিকল্প নেতৃত্ব সামনে আনার চেষ্টা করছেন। এতে দলটিতে ফের বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দলীয় চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতা খর্ব করতে চাইছে একটি পক্ষ। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহযোগীর তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আছে নানা আলোচনা। দলটির নেতারা মামলা ও বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন এমন আলোচনাও আছে। এই অবস্থায় দলের ভেতরের বিভক্তি নেতাকর্মীদের নতুন করে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় পার্টির অবস্থা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীরা হামলা ও মবের শিকার হয়েছে। মামলাও হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। দলটির এমন অবস্থার পেছনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্ত ও নিজেদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়াকে বড় কারণ মনে করছেন নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে ’২৪-এর নির্বাচনে তৃণমূলের মতামতকে উপেক্ষা করেই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় দল এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ১৫ বছরের শাসনামলে জাতীয় পার্টি পুরো সময়টাতেই ছিল সুবিধাবাদী ভূমিকায়। সরকারের ভেতরে ও বাইরে থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর বদলে গেছে পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা, নেতাদের বিচারের দাবি তোলা হয় বিভিন্ন পক্ষ থেকে। এমন দাবির প্রেক্ষিতে মামলাও হয়েছে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন স্থানে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে তিনি বাধার মুখে পড়েছেন।
আসছে ২৮শে জুন দলটির কাউন্সিল আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের। কিন্তু নেতৃত্ব নিয়ে নতুন মেরুকরণ তৈরি হওয়ায় শেষ মুহূর্তে এই সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদ হারানোর আশঙ্কায় কাউন্সিল বাতিল করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন শীর্ষ দুই নেতা। দলটির তরফে জানানো হয়, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র ভেন্যু হিসেবে না পাওয়ায় আপাতত সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু নেতারা বলছেন, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র না পাওয়া গেলে কাকরাইলে দলীয় কার্যালয়ে সম্মেলন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। দলীয়ভাবে কাউন্সিল বন্ধ ঘোষণা করার পর সিনিয়র নেতা কো- চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এককভাবে কাউন্সিল করার ঘোষণা দেন। তারা চেয়ারম্যান ও মহাসচিব হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। পরে অবশ্য তারা এমন অবস্থান থেকে সরে আসেন। অন্যদিকে জিএম কাদের নিজের পদ ধরে রেখে মহাসচিব করতে চান বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বা কো-চেয়ারম্যান শামিম হায়দার পাটোয়ারীকে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের এটি একটি বড় কারণ।
দলের কয়েকজন নেতা গঠনতন্ত্রের ২০ এর ১ (ক) ধারা বাতিল করতে চান। এই ধারার ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যান কোনো কারণ ছাড়াই কাউকে বহিষ্কার করতে পারেন। তারা বলছেন, এই ক্ষমতাবলে দলের চেয়ারম্যান ‘স্বৈরাচার’ হয়ে ওঠেন। তারা এই সুযোগ বন্ধ করতে চান। এমন দাবি নিয়ে মাঠে থাকা নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রওশন এরশাদের সঙ্গে থাকা নেতারাও। এরমধ্যে রয়েছেন কাজী ফিরোজ রশীদ, আবু হোসেন বাবলা, কাজী মামুনুর রশীদ।
নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলের ভেতরে এই দ্বন্দ্বের পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতি করতে হলে নেতৃত্বের বদল প্রয়োজন বলে মনে করছেন কোনো কোনো নেতা। এ ছাড়া আসছে নির্বাচনে দলটির অংশ নেয়া এবং অবস্থান তৈরির জন্য বিদেশি বন্ধুদের পরামর্শও থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
গত সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সরজমিন দেখা যায় সেখানে অনেকটা গুমোট পরিস্থিতি। ঢাকা মহানগর উত্তরের একজন নেতা মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে নিজের নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমি জিএম কাদের প্যানেলের নেতা। রাজনীতি করার জন্য প্যানেল মেইনটেইন করতে হয়। কিন্তু আমরা স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নেবো না। জিএম কাদের একজন আমলা। ’২৪-এর নির্বাচনে তিনি সামান্যতম শক্ত অবস্থান নিলে বিপদে পড়তো আওয়ামী লীগ। আমরা হতাম জাতীয় বীর।
রংপুরের জাতীয় পার্টির একজন নেতা বলেন, এখন যা চলছে তাতে রংপুরেও আসন পাওয়া কঠিন হবে জাপার। বিএনপি নেতা ইশরাকের দেখাদেখি মেয়র আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নেবার কথা শুনেছি। কিন্তু জিএম কাদেরের বাসায় হামলার ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি প্রেক্ষাপট বদলে দেয়। পরে আর সিটি করপোরেশন নিয়ে নেতারা ভাবতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় পার্টি দৃশ্যত কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। রমজানে কোথাও কোথাও ইফতার মাহফিল করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এমনকি ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর পক্ষে মিছিল করতে গিয়েও বাধার মুখে পড়ে। তৃণমূলে জাতীয় পার্টির নামে প্রকাশ্য হতেও ভয় পাচ্ছেন নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় কাউন্সিল আহ্বানকেও সন্দেহের চোখে দেখছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের আগে কাউন্সিল না করে এখন প্রতিকূল সময়ে কাউন্সিল আহ্বান করার অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। দলটির সর্বশেষ কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৪ই জুলাই।
দলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আমরা কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের পরিবর্তন আনতে চাই। নির্বাচন কমিশনে কাউন্সিলের তারিখ জানানো হয়েছে। এটা বাতিল উনি করতে পারেন না। জিএম কাদের যদি কারও সঙ্গে আলোচনা না করে কাউন্সিল বন্ধ করেন তাহলে তো হবে না। স্থগিত করতে হলেও তো আলোচনা করা উচিত ছিল।
তিনি বলেন, আমরা ঐক্য গড়ে তুলতে চাই। যারা আসতে চান, তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা চাই পার্টিকে সুসংগঠিত করতে। গণতান্ত্রিক ধারাগুলো ফিরিয়ে আনতে চাই।
রওশন এরশাদপন্থি দলের অন্য অংশের মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, সম্মেলনের দাওয়াত পেয়েছি। আমাদের কিছু কিছু লোক এখানে যুক্ত হয়েছেন। কারণ আমরা ঐক্য চাই। কিন্তু জিএম কাদের যদি সম্মেলন স্থগিত করেন তবে ঐক্যটাই তো হবে না।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থী হবেন। আমি জিএম কাদেরের প্যানেলে মহাসচিবের পদে দাঁড়াবো। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলন হবে। সেটা না হলে কাকরাইলে হবে। কিন্তু প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করেই জিএম কাদের তা বাতিল করেছেন। তিনি আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। বক্তব্য জানতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি।
পাঠকের মতামত
চুন্নু,আনিসুল, রুহুল আমিন- এগুলো সব হাসিনার দোসর। হাসিনার পা চেটে ক্ষমতা ভোগ করেছে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম দোসর, মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে আইনের আওতায় এনে বিচার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কাদেরকে সরিয়ে জাপার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়া উচিৎ ।