ঢাকা, ২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৬ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

থামছেই না মবের ঘটনা, উদ্বেগ

শুভ্র দেব
২৪ জুন ২০২৫, মঙ্গলবার
mzamin

বন্ধ হচ্ছে না মবের ঘটনা। সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মব বন্ধে নানা উদ্যোগ নিলেও এখনো বিভিন্ন স্থানে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সর্বশেষ মবের শিকার হয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। তাকে আটকের পর লাঞ্ছিত করার ঘটনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। 

মবের নামে পিটিয়ে হত্যা, মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া, লুটপাট, হেনস্তা, পদ থেকে সরিয়ে দেয়া, জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো, ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াসহ সবই করেছে দুর্বৃত্তরা। রাজনীতিবিদ, পুলিশ, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মবের শিকার হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার মবের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং গণ-অভ্যুত্থানের পর মব জাস্টিস মহামারী আকার ধারণ করে। কাউকে হেনস্তা বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও প্রতিশোধের মাধ্যম হয়ে ওঠে মব। পছন্দের পদে বসতে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মব সৃষ্টি করে অনেকেই ফায়দা হাসিল করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের ১০ মাস পরেও এখনো মব জাস্টিস হওয়াতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা এসব ঘটনা বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মব জাস্টিসের কারণে অনেক সময় নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব ঘটনা ঘটায় সমাজে নেগেটিভ বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে পছন্দের জায়গায় বসানো, দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অভিযোগ আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করে নিজেই বিচার করতে চাচ্ছে। কখনো প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক তকমা, কখনো দুর্নীতির অভিযোগ, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থানের অভিযোগ আনা হচ্ছে। কিন্তু এসব ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে না। যাদের এসব নিয়ে কাজ করার কথা, সেই পুলিশ সদস্যরাও এসব বিষয় দেখেও না দেখার ভান করছেন। ফলে যারা এসব করছেন তারা আইনের আওতায় না আসায় একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, যারা মব জাস্টিসের সঙ্গে জড়িত তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করছে। এক গোষ্ঠী একসঙ্গে হয়ে যখন এসব কর্মকাণ্ড করে তখন অন্যরা নীরব ভূমিকা পালন করে।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মবের কারণে মানুষ হত্যা, গণপিটুনি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। অনেকেই চাকরিহারা ও পদহারা হয়েছেন। এতে করে মব জাস্টিস এখন রীতিমতো আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ই আগস্টের পর রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে গণপিটুনি, চাকরি থেকে অপসারণের দাবি, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জেরে আওয়ামী লীগ বানিয়ে মামলার আসামি, চাকরি থেকে অব্যাহতির মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। এ ছাড়া বাসা-বাড়িতে আক্রমণ, পুড়িয়ে দেয়া, মালামাল লুটের মতো ঘটনা ঘটে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশের শক্ত অবস্থান না থাকাতে মব সন্ত্রাসীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ ছাড়া, মব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনাও বিরল। গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সুযোগ পেয়েছিল তারা। কিন্তু ১০ মাস পরেও পুলিশের কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না।  

সাবেক সিইসি নূরুল হুদাকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় দলের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা চাই কোনো ব্যক্তি যতবড় অপরাধীই হোন না কেন তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।

একইদিন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কে এম নূরুল হুদার ওপর যা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই উনার ওপর হামলা হয়েছে। এজন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত করে দেখা হবে কারা এর সঙ্গে জড়িত। যদি কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি কোনো অপরাধী থাকে, তাহলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করবেন। বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোনো অবস্থাতেই হাতে আইন তুলে নেয়া যাবে না।

মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, যত বড়ই অপরাধীই হোক তার বিচার আইনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। কিন্তু কোনোভাবে মব সন্ত্রাসের মধ্যদিয়ে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিগৃহীত করা এবং অপদস্ত করা কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। এ দায় সরকার এড়াতে পারে না। দেশে একটা অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য একটি গ্রুপ এ ধরনের মব সন্ত্রাস করে যাচ্ছে। যারা ফায়দা লুটতে চায়, নতুন রাজনীতি চিন্তা করে তাদের মধ্য থেকে হটকারী অংশ এটা করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, মব ছোঁয়াচে অসুখের মতো। এটা বন্ধ করতে না পারলে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। যেকোনো পরিস্থিতিতে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা তৈরি হয় এবং এসব ঘটনায় যারা সংখ্যার বিচারে শক্তিশালী হয়, তারা দুর্বলদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখন যে মব হচ্ছে সেগুলো একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রমাণও থাকতে পারে। সেটি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হবে। এখন মানুষ যদি নিজেই আইন তুলে নেয়, তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে নৈতিক কোনো ব্যবধান থাকবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আসলে রাজনৈতিক মামলায় বিচার হয় না। হয় মীমাংসা। আর মীমাংসা হয় বলে কেউ আস্থা রাখতে পারে না। তাই অনেকে চিন্তা করে মামলা হয়েছে কয়েকদিন জেল খেটে বের হয়ে যাবে- এটাই কি তার কৃতকর্মের বিচার। এর থেকে বেশি শাস্তি তার প্রাপ্য। তখন আইনের শাসনের প্রতি মানুষের অনাস্থা চলে আসে। নিজেই শাস্তি দিতে গিয়ে অপরাধ করে। তাই মবের বিরুদ্ধে আওয়াজটা হতে হবে জোরালো আওয়াজ।

সিনিয়র আইনজীবী শাহদিন মালিক মানবজমিনকে বলেন, একটা মব জাস্টিসের ঘটনায় অনেকগুলো অপরাধ সংঘটিত হয়। কারও বাসা-বাড়িতে অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ, ভাঙচুর, মারধর করা, জোর করে নিয়ে যাওয়া সবই বিভিন্ন ধারার অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে তারা এসব অপরাধমূলক কাজ বেশি বেশি করছে। কারও বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অভিযোগ থাকে, তবে থানায় গিয়ে এজাহার করবে। এজাহারের প্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে। সাবেক সিইসি’র ঘটনায় বিএনপি মামলা করেছে। পুলিশ হয়তো তাকে গ্রেপ্তার করতো। কিন্তু তার আগেই মব জাস্টিস করা হয়েছে তার সঙ্গে। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় পুলিশের তৎপরতা না থাকায় মানুষ এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে না। আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পরে কয়েক মাস হয়তো দেশ পরিচালনায় বিশৃঙ্খলা ছিল। পুলিশ বাহিনীও সঠিক অবস্থায় ছিল না। কিন্তু ১০ মাস পরেও এসব ঘটনা ঘটছে। এটা সরকারের একটা অন্যতম ব্যর্থতা। এ রকম হলে যে কারও বাসায় যে কেউ সংগঠিত হয়ে বিনা কারণে ঢুকে যেতে পারে। একজন একটা কথা বললো কিন্তু সেটা কারও পছন্দ হলো না। কিন্তু এর জন্য জোর করে কারও বাসায় প্রবেশ ভাঙচুর ও কাউকে তুলে নেয়া যাবে না। 
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status