প্রথম পাতা
যুদ্ধে জড়ালো যুক্তরাষ্ট্র
মানবজমিন ডেস্ক
২৩ জুন ২০২৫, সোমবার
ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফোটেনি। অনেক মানুষ গভীর ঘুমে। ঠিক এমন সময় বিকট শব্দ। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাজধানী তেহরান, কোম নগরী আর ইস্ফাহান। তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় থর থর করে কেঁপে ওঠে চারদিক। সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য তো অবশ্যই, তার বাইরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এক হিম শিহরণ। এক অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে সবাইকে। অপারেশন মিডনাইট হ্যামার নামের হামলার মধ্যদিয়ে ইরান যুদ্ধে ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়লো যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলায় ইরান আক্রান্ত হলেও সেই ইরানকেই পাল্টা জবাব দেয়ার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছে বৃটেন। প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার বলেছেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেয়া হবে না। তাদেরকে সংযত থেকে কূটনৈতিক ব্যবস্থায় সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান দমিত্রি মেদভেদেভ বলেন, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র দিতে প্রস্তুত একাধিক দেশ। একই সঙ্গে রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা লিওনিদ স্লুটস্কি বলেছেন, সহিংসতার পরিণতি এ অঞ্চলের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেখা দিতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ অবস্থায় আজ সোমবার রাশিয়া সফরে যাচ্ছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। পরিস্থিতি প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে। ফলে যেকোনো একটি ছোট্ট ভুলের কারণে মধ্যপ্রাচ্য জ্বলে ছারখার হয়ে যেতে পারে। বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে উদ্বেগ, সতর্কতা দিলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তারা অবস্থান পরিষ্কার করছে না।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা যখন আক্রান্ত তখন সৌদি আরব থেকে প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়- ইরানে পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার ফলে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করা যায়নি। মুসলিমদের মোড়ল হিসেবে এটাই কী তাদের জন্য যথেষ্ট প্রতিক্রিয়া! এমন জিজ্ঞাসা জনে জনে। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন অভিযানের। বলেন, শত্রুদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ইরানে আরও স্থাপনা আছে। ইরান যদি দ্রুত চুক্তিতে না আসে তবে সেগুলোকে টার্গেট করা হবে। তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভূয়সী প্রশংসা করেন। হামলায় ব্যবহার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্টিলথ যুদ্ধবিমান। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সম্মিলিত যুদ্ধ এখন একটি দেশের বিরুদ্ধে- তারা ইরান। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের আক্রমণের মুখে পড়ে মাথানত না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইরানি নেতারা। পক্ষান্তরে তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন আহ্বানের অনুরোধ করেছেন। বিশ্বনেতারা এ আতঙ্কে উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। রাশিয়া সাফ জানিয়ে দিয়েছে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন।
এ হামলার পেছনে যে যুক্তিই দেয়া হোক না কেন- আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এই হামলা। আমরা আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি। চীনও কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি আবার ইরাকের সেই একই ভুল করছে ইরানে? ২০০৩ সালে তাদের ইরাক আক্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী সংকট ও অস্থিতিশীলতা এনেছে। ইতিহাস বার বার তা প্রমাণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ে জাপান সহ বিভিন্ন দেশ জরুরি মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেছে। এখন ইরান কী জবাব দেবে- সেটা দেখার বিষয়। আগে থেকেই তারা সতর্ক করেছে। বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িত হয় তাহলে তাদের ঘাঁটি টার্গেট করা হবে। একই সঙ্গে ইসরাইলকে যেসব প্রতিবেশী দেশ সহযোগিতা করবে তাদের পরিণতিও একই হবে। তবে তাদেরকে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। বলেছেন, ইরান কোনো হামলা চালালে তার ভয়াবহ জবাব দেয়া হবে। তাদের অভিযানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। ইরান অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সামরিক জবাব দেয়নি। তবে তারা আক্রান্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ইসরাইলে বৃষ্টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসেবে ইসরাইল এর ফলে ক্ষয়ক্ষতিকে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। অন্যদিকে তারাও ইরানে হামলা চালায়। গতকাল দফায় দফায় এ হামলা ও পাল্টা হামলা হতে থাকে।
ট্রাম্পের ঘোষণা: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের ফরদোসহ ৩টি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো হলো ফরদো, নাতানজ ও ইস্ফাহান। তিনি একে ‘অত্যন্ত সফল’ অভিযান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেন, ফরদো স্থাপনাটিতে ‘পূর্ণ ক্ষমতার’ বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। তবে ইরান জানিয়েছে, হামলার আগেই ওইসব স্থাপনা থেকে তারা পারমাণবিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিয়েছে। ওদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমও ফরদো স্থাপনাটিতে ‘শত্রু পক্ষের আক্রমণ’ হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা সম্পর্কে এখনো কোনো বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়নি। বিশ্ব নেতারা ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
‘ইসরাইলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস’- ট্রাম্প: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প টেলিভিশন ভাষণে জানিয়েছেন, ইরানের ফরদো, নাতানজ ও ইস্ফাহানে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর চালানো বিমান হামলা ছিল ‘চমৎকার সামরিক সাফল্য’। তিনি বলেন, এসব স্থাপনা সম্পূর্ণরূপে এবং একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ট্রাম্পের ভাষণ ছিল সংক্ষিপ্ত- মাত্র চার মিনিট। কিন্তু তাতে ছিল বিস্ফোরক বার্তা, যুদ্ধের হুমকি এবং একটি স্পষ্ট অঙ্গীকার- ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করেছে। ইরানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এই ভয়ঙ্কর হুমকি মুছে ফেলতে হবে। ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ইরানের কুদ্স বাহিনীর সাবেক কমান্ডার কাসেম সোলায়মানি হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছেন। আমি অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি আর এটা চলতে দেবো না। এটা এখন থেমে যাবে। তিনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আমরা একটি টিম হিসেবে কাজ করেছি। এই অভিযান ছিল ইসরাইলের জন্য একটি ঐতিহাসিক বিজয়। ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আজকের আক্রমণ ছিল সবচেয়ে কঠিন ও সম্ভবত সবচেয়ে বিধ্বংসী। কিন্তু যদি দ্রুত শান্তি না আসে, তাহলে পরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আরও নিখুঁত, দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে হামলা হবে। তিনি বলেন, রোববার ভোরের হামলা কেবল শুরু। আমাদের হাতে এখনো অনেক লক্ষ্য আছে। এ সময় তার পাশে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা।’
ট্রাম্পকে অভিনন্দন নেতানিয়াহুর, বললেন ‘ইতিহাস বদলে যাবে’: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন হামলার পর প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এক ভিডিও বার্তায় তিনি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ধর্ষ ও ইতিহাস বদলানো’ পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেন। নেতানিয়াহু বলেন- ‘অভিনন্দন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত ও ভয়ঙ্কর শক্তিতে আঘাত হানার যে সাহসিক সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছেন, তা ইতিহাস বদলে দেবে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘অপারেশন রাইজিং লায়নে ইসরাইল অসাধারণ কিছু করেছে। কিন্তু শনিবার রাতে আমেরিকার অভিযান তুলনাহীন।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাবে ইরানের সকল বিকল্প উন্মুক্ত: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে চালানো বিমান হামলাকে ভয়াবহ উস্কানি বলে অভিহিত করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ আব্বাস আরাঘচি। তিনি বলেছেন এই হামলার স্থায়ী পরিণতি থাকবে। ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সকল বিকল্প উন্মুক্ত রেখেছে। তিনি শনিবার এক্সে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, রোববারের ঘটনাগুলো চরমভাবে উদ্বেগজনক এবং তা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের এখনই সজাগ হওয়া উচিত। আরাঘচি আরও বলেন, যে দেশ নিজেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, সেই যুক্তরাষ্ট্রই আজ জাতিসংঘ সনদের চরম লঙ্ঘন করেছে। তিনি এটিকে আইনবহির্ভূত, অপরাধমূলক এবং বিশ্বশান্তির জন্য সরাসরি হুমকি বলে আখ্যায়িত করেন। ‘সকল বিকল্প উন্মুক্ত’ রাখার ঘোষণা ইঙ্গিত করছে যে, ইরান প্রতিশোধমূলক সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ঘাঁটিতে আঘাত হানতে পারে বা মিত্রদের মাধ্যমে প্রক্সি যুদ্ধের বিস্তার ঘটাতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে অনিশ্চয়তা: যুদ্ধের সমাপ্তি, না কি নতুন ধ্বংসযুদ্ধের শুরু?: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার পর নতুন করে উত্তেজনার আগুন জ্বলছে মধ্যপ্রাচ্যে। প্রশ্ন এখন একটি- এটা কি যুদ্ধের শেষ পর্বের সূচনা, না কি আরও ভয়াবহ একটি অধ্যায়ের দরজা খুলে গেল? ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে এসেছে, তারা এককভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু এটাও সবার জানা, বিশেষ করে ফরদোর মতো মাটির অনেক গভীরে নির্মিত স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর শক্তিশালী বোমাগুলোর- যা কেবল আমেরিকারই রয়েছে। এখন যদি সত্যিই ফরদো, নাতানজ ও ইসফাহানের স্থাপনাগুলো অকার্যকর হয়ে যায়, তাহলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার মূল লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলে ঘোষণা দিতে পারেন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়- এই অভিযান কি শেষ না নতুন শুরু?
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক চাইলো ইরান: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার জবাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের দাবি জানিয়েছে ইরান। এই দাবির কথা জানিয়েছে আধা-সরকারি ফার্স নিউজ এজেন্সি। জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই হামলা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের চরম লঙ্ঘন। এটি একটি স্পষ্ট ও বেআইনি আগ্রাসন। ইরানি মিশন জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, এই বর্বর হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া ভাষায় নিন্দা জানানো হোক এবং জাতিসংঘ সনদের আওতায় পরিষদের দায়িত্ব অনুযায়ী সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক, যাতে এই অপরাধের নায়ক দায়মুক্তি না পায় এবং পূর্ণ জবাবদিহির আওতায় আসে। ইরান এই হামলাকে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন এবং জাতিসংঘ সনদের ২ (৪) ধারা অনুযায়ী ‘অবৈধ শক্তি প্রয়োগ’ হিসেবে চিহ্নিত করছে।
হামলার বিরুদ্ধে কিউবা, চিলি, মেক্সিকো ও ভেনেজুয়েলা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিমান হামলায় বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ এই হামলার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও মানবতার জন্য বিপজ্জনক হুমকি বলে অভিহিত করেছে। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াস-কানেল হামলাকে ‘বিপজ্জনক উস্কানি’ এবং জাতিসংঘ সনদের সরাসরি লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই হামলা মানবতাকে এমন এক সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যার পরিণতি হতে পারে অপরিবর্তনীয়। এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু যুদ্ধ নয়, সারা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিচ এক পোস্টে লিখেছেন, চিলি এই হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। কেবল শক্তি থাকার অর্থ এই নয় যে, আপনি তা ব্যবহার করবেন মানবতার নির্ধারিত নিয়ম লঙ্ঘন করে- এমনকি আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপকে ‘বেআইনি’ বলে আখ্যায়িত করেন। মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সংবিধানভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির নীতিমালা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির আলোকে, আমরা অঞ্চল জুড়ে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছি। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল টেলিগ্রামে দেয়া বিবৃতিতে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী ইসরাইলের অনুরোধে এই বোমা হামলা চালিয়েছে- আমরা এই হামলার দৃঢ় ও পরিষ্কার নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, আমরা অবিলম্বে সকল ধরনের শত্রুতার অবসান দাবি করছি। এ অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্বার্থে এটাই একমাত্র যৌক্তিক পথ।
তেহরানের নির্দেশ ছাড়াই হামলা করতে পারে ইরানের মিত্ররা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ফোরামের পরিচালক শাহরাম আকবরজাদেহ আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বর্তমানে যে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত, তা হলো- এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় পুরো অঞ্চল জুড়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ইরান এই হামলার বিরুদ্ধে জবাব দেবে- এটা স্পষ্ট করেছে। তবে তেহরানের মিত্র ও প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর অনেকেই হয়তো কোনো আনুষ্ঠানিক আদেশের অপেক্ষা না করে নিজেরাই পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে। আকবরজাদেহ আরও বলেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য ঘাঁটি, সামরিক স্থাপনা ও কূটনৈতিক কেন্দ্র রয়েছে। হিজবুল্লাহ, হুতি, শিয়া মিলিশিয়া কিংবা অন্য কোনো ইরানপন্থি গোষ্ঠী সহজেই এসবকে টার্গেট করতে পারে।
ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে নিজ দেশেই সমালোচিত ট্রাম্প: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে যুদ্ধ চালানোর অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, এই পদক্ষেপ একটি দীর্ঘমেয়াদি, বিধ্বংসী যুদ্ধের সম্ভাবনাকে ভয়াবহভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। শুমার এক বিবৃতিতে বলেন, কোনো প্রেসিডেন্টেরই এককভাবে জাতিকে এমন একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধে টেনে নেয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে যখন তার হুমকিগুলোর ধরন এলোমেলো এবং কোনো সুসংগঠিত কৌশল নেই। তিনি আরও বলেন, ইরানের সন্ত্রাসবাদ, পারমাণবিক উচ্চাকাঙক্ষা ও আঞ্চলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে শক্তি, দৃঢ়তা এবং কৌশলগত স্বচ্ছতা প্রয়োজন। অথচ এই পদক্ষেপে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী, বিস্তৃত ও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এর প্রেক্ষাপটে শুমার ‘ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ আইনের আওতায় প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ ক্ষমতা সীমিত করতে একটি তাৎক্ষণিক ভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি সিনেট নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাচ্ছি- এই আইনটি দ্রুত সিনেটের ভোটের জন্য উপস্থাপন করুন। আমি এই আইনের পক্ষে ভোট দেব এবং উভয় দলের সিনেটরদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারাও ভোট দিন। ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট এমন একটি আইন, যা প্রেসিডেন্টের বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষমতা সীমিত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে হয়। শুমার বলেন, আমেরিকান জনগণ ও কংগ্রেসের সামনে প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে- আজকের হামলার উদ্দেশ্য কী, এবং এর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে।
ডেমোক্রেটদের কড়া নিন্দা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে চালানো বিমান হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা এই পদক্ষেপকে ‘কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধ শুরু করায় গুরুতর সংবিধান লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করছেন এবং প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট দাবি তুলছেন। নিউ ইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, এই পদক্ষেপ মার্কিন সংবিধান এবং কংগ্রেসের যুদ্ধক্ষমতা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। এটি ইমপিচমেন্টের স্পষ্ট ও নির্ভুল ভিত্তি। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প একপেশে, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি যুদ্ধ শুরু করার ঝুঁকি নিয়েছেন। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আটকে দিতে পারে। মিশিগানের কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তালিব বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘নিরস্ত্র ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মিথ্যা’ অপবাদ দিয়ে আমরা যে অন্তহীন যুদ্ধ পেয়েছি, তার পরিণতি দেখেছি। আমরা এবার সেই ফাঁদে পা দেবো না। তিনি কংগ্রেসকে ‘তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের’ আহ্বান জানিয়েছেন। ম্যাসাচুসেটসের কংগ্রেসম্যান জিম ম্যাকগভার্ন পরিস্থিতিকে সরাসরি ‘পাগলামি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই ইরানকে বোমা মেরেছেন। আমাদেরকে অবৈধভাবে আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছেন। আমরা কি কিছুই শিখিনি?
এই ঘটনার পর রিপাবলিকানদের একাংশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ বলে প্রশংসা করলেও, ডেমোক্রেটদের মধ্যে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে এটিকে সংবিধান লঙ্ঘন, যুদ্ধ ক্ষমতা আইনের অগ্রাহ্য এবং স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বলে নিন্দা জানানো হচ্ছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কংগ্রেস কি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট প্রয়োগ করবে? ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা হবে কি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- যুক্তরাষ্ট্র কি এখন একটি যুদ্ধের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, কংগ্রেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে?
যুক্তরাষ্ট্রের হামলা আন্তর্জাতিক শান্তিতে সরাসরি হুমকি: জাতিসংঘ, ইরাকের ভুল ইরানেও -চীন: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কঠোর বিবৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন দেশের নেতারা। তারা আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আরব নিউজ। জাতিসংঘ মহাসচিব বিবৃতিতে বলেছেন, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ভঙ্গুর বাস্তবতায় এক বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই সংঘাত যেকোনো মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে- যার পরিণতি সাধারণ মানুষ, পুরো অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য হবে ভয়াবহ। গুতেরেস জোর দিয়ে বলেন, এই সংকটময় সময়ে যুদ্ধ নয়, শান্তিই একমাত্র পথ। কূটনীতি ছাড়া কোনো সমাধান নেই।
নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেন, এই সংকট আমার দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ কূটনৈতিক পরিস্থিতিগুলোর একটি। এখন আলোচনায় ফিরে যাওয়াটাই একমাত্র টেকসই পথ। তিনি হামলার সরাসরি সমর্থন বা বিরোধিতা না করলেও কূটনৈতিক সমাধানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিজিটিএন মন্তব্য করেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি আবার ইরাকে করা ভুল ইরানেও করছে? তারা ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী সংকট ও অস্থিতিশীলতা এনেছে- ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা রোববার জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক ডেকেছেন। দেশের শীর্ষ সংবাদপত্র ইওমিউরি শিমবুন এই হামলার ওপর একটি বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করেছে, যা সচরাচর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেই দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় জানিয়েছে, এই হামলার ফলে নিরাপত্তা ও অর্থনীতির উপর প্রভাব নিয়ে জরুরি আলোচনা চলছে। তেহরানে অবস্থিত নিজেদের দূতাবাস আগেই বন্ধ করা অস্ট্রেলিয়া সরকার বলেছে, আমরা শুরু থেকেই বলছি ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য হুমকি। তবে এই মুহূর্তে দরকার উত্তেজনা প্রশমন ও সংলাপ।