অভিশংসন করা যাবে প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিকে

৩রা আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একদফার ঘোষণাতেই ফ্যাসিবাদের বিলোপের কথা বলেছিলেন নাহিদ ইসলাম। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে আসছেন অভ্যুত্থানে  নেতৃত্ব দেয়া নেতারা। এক সময়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেছেন। গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি তার নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র। আত্মপ্রকাশের পর থেকে রাজনীতিতে নতুনত্ব আনার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তারই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার চূড়ান্ত হয়েছে এনসিপি’র গঠনতন্ত্র। যেখানে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অভিশংসনের বিধান রাখা হয়েছে। জাতীয় পরিষদের অন্তত ২০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে শীর্ষ এ দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবে। এ ছাড়াও শীর্ষ দুই পদে কেউ দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। 

এনসিপি’র নেতারা বলছেন, এটি বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনীতির ধারণা পাল্টে দেবে। পারিবারিক রাজনীতি ও এক ব্যক্তির ক্ষমতায়নের যে চর্চা এতদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলমান রয়েছে এনসিপি সেটি বিলোপের পথ দেখাচ্ছে। গত শুক্রবার রাজধানীর বাংলামোটরের রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে এনসিপি’র অস্থায়ী কার্যালয়ে দলটির ৬ষ্ঠ সাধারণ সভায় গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিবৃতি দেয়া হয়। যেখানে ৮টি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের বিষয় জানানো হয়। সেগুলো হলো- জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটি’র সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সারা দেশের কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। একজন সদস্য জীবনে সর্বোচ্চ দুইবার সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ দুইবার সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন; সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ‘রাজনৈতিক পরিষদ’-এর নিকট দায়বদ্ধ থাকবে; জাতীয় নাগরিক পার্টি’র একটি ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ থাকবে। ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ ন্যাশনাল কাউন্সিলের ভোটে নির্বাচিত হবে।

 ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ সর্বনিম্ন ১১ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট হবে। ১১ জন সদস্য ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’-এর ভোটে নির্বাচিত হবেন; তন্মধ্যে ন্যূনতম তিনজন নারী সদস্য থাকতে হবে। পদাধিকারবলে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাজনৈতিক পর্ষদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই পর্ষদের বাকি দুইজন সদস্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বারা মনোনীত হবেন; জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র একটি ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’ থাকবে। এই কাউন্সিল ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ নির্বাচন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন এবং জরুরি সময়ে কিছু কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দায়িত্ব পালন করবেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটি, অঙ্গসংগঠনের নির্বাহী কমিটি, জেলা পদমর্যাদার কমিটি থেকে ৫ জন এবং উপজেলা পদমর্যাদার কমিটি থেকে ২ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে; জাতীয় নাগরিক পার্টির একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে। যা দলের সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলী, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাধারণ সদস্য এবং ক্ষেত্রবিশেষ জেলা সভাপতির সমন্বয়ে গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। 

মেয়াদের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে; দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন দাখিল করার ব্যাপারে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সামগ্রিক যোগাযোগের জন্য দলের পক্ষ থেকে মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম-আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, যুগ্ম-সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসাকে সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সভায় উপরোক্ত সংশোধনীসমূহসহ জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি’র ‘খসড়া গঠনতন্ত্র’ পাস হয়। গৃহীত ‘খসড়া গঠনতন্ত্র’ আগামী কাউন্সিলের পূর্বে প্রয়োজন সাপেক্ষে বর্তমান প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটি সংশোধনী আনতে পারবে। ওইদিন সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সারা দেশের কাউন্সিলরদের ভোটে স্বতন্ত্রভাবে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন। কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় দু’বারের বেশি সাধারণ সম্পাদক কিংবা সভাপতি পদে থাকতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। মেয়াদের শেষ তিন মাসের মধ্যেই পরবর্তী কাউন্সিল সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়াও দলীয় প্রধান সরকারপ্রধান হতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয় এনসিপি’র সাধারণ সভায়। আর কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা কমিটি একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিটির মাধ্যমে গঠিত হবে। এদিকে আজ নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে যাচ্ছে এনসিপি। দলটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। 

এনসিপি’র যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিয়ন বলেন, আমাদের গঠনতন্ত্র এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যেন কেউ দলের মধ্যে একক ক্ষমতাবান না হয়ে উঠতে পারেন। আমরা ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেটি এনসিপি গঠন হওয়ার পূর্বে আমাদের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও ঘোষণা করেছিলেন। নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষাকে ও গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করেই আমাদের রাজনীতি পরিচালিত হবে। তিনি বলেন, দল পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায্যতা সবকিছুর যেন চর্চা হয় সে বিষয়গুলো গঠনতন্ত্রে গুরুত্ব পেয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাদের জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা দলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেটি পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির যে চর্চা আমাদের দেশে চলে আসছে সেটিকে বিদায় করবে এবং এটি অন্যান্য দলের মধ্যেও চর্চা করার সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়াও জাতীয় কাউন্সিলের ২০ শতাংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রস্তাব করা যাবে। 

লিয়ন বলেন, এনসিপি’র সকল কমিটি নির্বাচিত হবে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে। যারা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কমিটিগুলো গঠন করবে। তিনি বলেন, আমরা কেবল দল নয় বরং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও এগুলো প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সেজন্য এসব স্বচ্ছতা গঠনতন্ত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা ইতিমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেও রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো দিচ্ছি। নিয়মিত আমাদের বক্তব্য তুলে ধরছি। যাতে রাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা চাই আমাদের গণ-অভ্যুত্থানের যে আকাঙ্ক্ষা সেটির বাস্তবায়ন। এটিকে বিপ্লবে রূপ দিতে চাই। জনগণের সমর্থন নিয়ে রাজনীতিতে আমরা এসব মৌলিক সংস্কার আনতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।