ঢাকা, ২২ জুন ২০২৫, রবিবার, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

ইরান-ইসরাইল সংঘাত

পোশাকখাতে নয়া চ্যালেঞ্জ

এমএম মাসুদ
২২ জুন ২০২৫, রবিবার

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক, ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চলমান ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ পোশাক শিল্পের জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব বাধায় শিল্পের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান নানা কারণে বন্ধ হয়েছে। এতে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে বেকার হয়েছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। তবে কিছু নতুন কারখানাও চালু হয়েছে। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও শিল্প পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে শঙ্কা অর্থনীতিবিদ এবং খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
উদ্যোক্তারা বলছেন, শিল্পকারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে। এ অবস্থায় জ্বালানি বিভাগ নতুন করে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা পরিস্থিতি আরও সংকটময় করে তুলছে। এরমধ্যে নতুন করে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। 

জানা গেছে, গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে শিল্পের মালিকের সম্পর্ক, রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থনৈতিক দুর্নীতির কারণে গত সাড়ে ১০ মাসে দেশের শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় এসেছে। ঊর্ধ্বমুখী সুদহারে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন না হওয়ায় কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। শিল্প পুলিশের তথ্যানুযায়ী, প্রধান তিন শিল্প এলাকা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী এবং সাভার-ধামরাই এলাকায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন ৬০ হাজারের বেশি কর্মী।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস্‌ এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেছেন, শিল্পবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিল্পকারখানা গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। গ্যাস সংকটে আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। চলতি মূলধন সংকুচিত হয়েছে। 

বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ইসরাইল ও ইরানের যুদ্ধ আমাদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব সবার ওপর পড়বে। পোশাক শিল্পও এর প্রভাব থেকে বাদ যাবে না। 
এদিকে, শুক্রবার মৌলভীবাজারে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ইরান ও ইসরাইলের চলমান যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগেভাগেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে সরকার।

নানামুখী সংকট: সাম্প্রতিক সময়ে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অস্থিরতায় প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। রপ্তানি আয়ে আগামী দিনে কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে বাংলাদেশের পণ্যে, যার পরিমাণ ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতি ৩ মাসের স্থগিতাদেশ আগামী ৯ই জুলাই শেষ হচ্ছে। এ জন্য পশ্চিমা অনেক ক্রেতা পোশাকের আগামী প্রান্তিকের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। তাই রপ্তানি আয়ের সফলতা নিয়ে আগামী দিনে শঙ্কা ভর করেছে। অন্যদিকে, এ বছরের ১৭ই মে সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারত। এর ফলে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রায় ৪২ শতাংশ রপ্তানি প্রভাবিত হচ্ছে এবং রপ্তানিকারকদের জন্য সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল সমুদ্রপথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ছে।
এদকে, ইসরাইল ও ইরানের যুদ্ধে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাব সবার ওপর পড়বে। পোশাক শিল্পও এর প্রভাব থেকে বাদ যাবে না। 

এসব চ্যালেঞ্জের মাঝে ক্রেতাদের অর্ডার নিয়ে বিপাকে পড়েছে পোশাক খাত। আগামী দুই মৌসুমে পোশাকের বাজারে এই প্রভাব পড়লে অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট দেখা দিতে পারে। অবশ্য বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, ডনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎস দেশগুলোর জন্য প্রস্তাবিত হার পুনর্বিবেচনা করবে।

জিডিপি বিনিয়োগ কমছে: বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে, চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৩% পর্যন্ত নেমে আসতে পারে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন- এমন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমবে উল্লেখযোগ্যহারে। এপ্রিলে দেয়া বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিনিয়োগের এ বেহাল দশা এবং অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যার সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৭০%-এর বেশি।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক- দুই দিক থেকেই আমরা সংকটে পড়েছি। যথাযথ নীতিগত সহায়তার অভাব, উচ্চ সুদের হার, গ্যাস সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা আমাদের খাতকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে অনেক টেক্সটাইল মিলের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নেমে গেছে। 

বিজিএমইএ’র সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ ব্যাংক সুদ, মুদ্রাস্ফীতি, দুর্বল অবকাঠামো ব্যবস্থা, মজুরি বৃদ্ধি এবং জ্বালানি সংকটে আমরা অনেকটা নিষ্পেষিত অবস্থায় আছি। এরমধ্যে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে ইসরাইল ও ইরান যুদ্ধ। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক আশরাফ আহমেদ বলেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে কারখানা চালানো দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠেছে। জ্বালানি সংকটে ভুগছে বেশির ভাগ কারখানা। কারখানায় উৎপাদন কম হলে এর প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়বে। অন্যদিকে, মালিকদের হাতে অর্থ নেই, কারখানায় উৎপাদন নেই; ফলাফল শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারা এবং অর্থনীতিতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এ সময়ে কোনো কোম্পানিই নীতিগত নিশ্চয়তা ছাড়া নতুন কোনো চুক্তিতে যেতে চাইবে না। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসা। বিশ্লেষকরা বলেন, আমাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা-ভিত্তিক প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে।

তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বিডার ফেসবুকে ‘আমাদের আমলনামা’ নামে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি জানান, গত অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় একই। যদিও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পরে এত তাড়াতাড়ি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ আগের জায়গায় ফিরে গেছে, যা আশার কথা।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status