ঢাকা, ১ জুলাই ২০২৫, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৪ মহরম ১৪৪৭ হিঃ

বাংলারজমিন

সুনামগঞ্জে ডুংরিয়া মডেল গ্রাম নির্মাণে আওয়ামী লীগ নেতার অনিয়ম

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
২১ জুন ২০২৫, শনিবার

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘ডুংরিয়া মডেল গ্রামে’ অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একজন সদস্যকে একাধিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের সুযোগ, অতিরিক্ত খাবার বিল, প্রশিক্ষণে ব্যয় বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঋণ বিতরণ করে কোটি কোটি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, ২০২৩ সালে ২ কোটি ৩২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা বাজেট নির্ধারণ করে আওয়ামী সরকারের আমলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের নিজ গ্রাম ডুংরিয়ায় অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু করে এলজিইডি। সাবেক এ মন্ত্রীর পরামর্শে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নূর হোসেনকে সভাপতি করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি নূর হোসেন পরিকল্পনামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বেপরোয়া ছিলেন। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করতেন তিনি। সভা সেমিনার প্রশিক্ষণে ১৪০ টাকার বিরিয়ানি কিনে ভাউচার করতেন ৩৮৫ টাকা। মডেল গ্রাম সমবায় সমিতির নীতিমালা অনুযায়ী সমিতির সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, ঋণ বিতরণের সুপারিশ করবে ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ নীতিমালার সুযোগ নিয়ে নুর হোসেন একেকজন সদস্যকে একাধিক দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন। ঋণ পছন্দের ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করেন তিনি। ২৪৬ জন সদস্যের মাঝে দেড় কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা সমবায় অফিসের তথ্যমতে, প্রতি সদস্যের কাছ থেকে শুরুতে ১৪শ’ টাকা করে আদায় করা হয়। এই টাকার মধ্যে ৫শ’ টাকা শেয়ার, ৫শ’ টাকা সঞ্চয়, ভর্তি ফিস ২শ’ টাকা ও বিবিধ খাতে জমা হয় ২শ’ টাকা। এতে মোট ৫৮০ জন সদস্যের কাছ থেকে আদায় করা হয়ে ৮ লাখ ১২ হাজার টাকা। বর্তমানে ব্যাংক হিসেবে জমা আছে  ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। বাকি ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে কমিটির তৎকালীন সভাপতি নুর হোসেন খরচ দেখিয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সেই হিসেবে ১ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ঘাটতি রয়েছে। যার খরচ দেখাতে পারেননি নুর হোসেন। তিনি প্রায় তিন বছর দায়িত্বে ছিলেন। গেল বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারিতে হওয়া নির্বাচনে মাধ্যমে দায়িত্ব পাওয়া নতুন কমিটি আগের ঘাটতির টাকার দায় নিতে চায়নি। প্রকল্পটি চালুর পরে গাভী পালন, মৎস্য চাষ, সবজি চাষ, গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগল-ভেরা ও হাঁস-মুরগি পালন বিষয়ে মোট দশটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তিনদিন মেয়াদি দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করা কমিটির সদস্যদের ১৫শ’ টাকা সম্মানী ও ৬শ’ টাকা যাতায়াত ভাতা প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও প্রতিটি প্রশিক্ষণের বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অন্যান্য খরচের মধ্যে সেখানে খাবার বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, প্রশিক্ষণে দুপুরে বিরিয়ানি খাওয়ালেও রেস্টুরেন্টের সাদা ভাউচার সংগ্রহ করে অতিরিক্ত টাকা খরচ দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ রকম একটি ভাউচার রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। শান্তিগঞ্জের রাজধানী রেস্টুরেন্টের ২০২২ সালের একটি ভাউচারে দেখা গেছে, দুপুরের খাবার বাবদ জনপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে ৩৮৫ টাকা। সে হিসেবে ৪৫ জনের দুপুরের খাবার বিল ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৩২৫ টাকা। এ বিষয়ে রাজধানী রেস্টুরেন্টের মালিক শ্যামল দেব বলেন, তাদের ৪টি প্রশিক্ষণে তিনি বিরিয়ানি সরবরাহ করেছিলেন। বিরিয়ানির মূল্য এখন নেয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। ২০২২ সালে ১৪০ টাকা করে বিরিয়ানি দেয়া হয়েছে। কর্মসূচি চলাকালে সাদা ভাউচারও নিয়েছেন তারা। এখন দেখি ভাউচারে ৩৮৫ টাকা লিখা রয়েছে। এই ভাউচারে লেখা ও স্বাক্ষর তার নয়। ডুংরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. শামীম মিয়া বলেন, কমিটি গঠনের জন্য প্রথম সভায় তিনি ছিলেন। দেখলাম কমিটিতে জায়গা পাওয়া আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তিরাও ঋণ পেয়েছেন, ঋণ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়েছেন। আর্থিক অসচ্ছল ব্যক্তিরা পেলে তারা উদ্যোক্তা হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারতো।
সমবায় সমিতির সদস্য মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সমিতির সদস্য হতে প্রথমে ১৪শ’ টাকা দিয়েছেন। এরপর দক্ষতা উন্নয়নের কোনো প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে ডাকা হয়নি। দুইদিন দুইটি সভায় উপস্থিত ছিলেন। পরে ৫০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ৬ মাস পর থেকে কিস্তির মাধ্যমে সে ঋণ পরিশোধ করেছেন তিনি। কমিটির সদস্য রমজান আলী বলেন, দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কমিটির সদস্য হলেও এখনো কোনো প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়নি তার। একদিন একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন, সেখানে ৫শ’ টাকা সম্মানী দেয়া হয়েছিল।
কমিটির সদস্য মো. আশিক মিয়া বললেন, তিনদিনের ২টি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রশিক্ষণে সকালে হালকা নাশতা ও দুপুরে বিরিয়ানির প্যাকেট ছিল। দুইটি প্রশিক্ষণে ৪ হাজার ২শ’ টাকা সম্মানী পেয়েছেন। এ ছাড়াও ৫০ হাজার টাকা ঋণ পাওয়ায় দোকানঘর সংস্কার করতে পেরেছেন তিনি। অভিযুক্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুর হোসেন ৫ই আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় তার ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসার মোহাম্মদ রুহুল হাসান বললেন, তিনি নতুন যোগদান করেছেন। এই বিষয়ে আগের কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। শান্তিগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসের প্রাক্তন কর্মকর্তা ও বর্তমান জেলা সমবায় অফিসের উপ-সহকারী নিবন্ধক অফিসার মোহাম্মদ মাসুদ আহমদ বলেন, সমবায় মডেল গ্রামের কার্যক্রম ২০২২ সালে শুরু হয়। তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্দেশে সেখানে ৮ জনসহ ৪ জন সরকারি কর্মকর্তা নিয়ে ১২ সদস্যবিশিষ্ট একটি ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির কাজ ছিল সদস্য নেয়া, প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা। এই বিষয়গুলো সমবায় অফিসারের এখতিয়ারের মধ্যে নয়। কমিটি একই ব্যক্তিকে একাধিক বার প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছিল। তাদের বাদ দেয়ারও আইনগত সুযোগ তাদের ছিল না। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের মালামাল একেক সময়ে একেক দোকান থেকে নেয়া হয়েছে। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও বিকালের নাশতার ব্যবস্থা ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য।
জেলা সমবায় অফিসার চন্দন দত্ত বললেন, এই বছরে কোনো ঋণ বিতরণ ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়নি, শুধুমাত্র উদ্বুদ্ধকরণ সভার বাজেট এসেছিল, সে সভাটি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখানে নতুন এসেছি। আগে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটি সরকারের একটি মডেল প্রকল্প, সারা দেশে ১০টি গ্রামে হয়েছে, এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ডুংরিয়ায় একটি। এটি আমাদের জন্য গর্বের। 
সুনামগঞ্জ এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভবনের কাজ শেষ করার কথা। কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়ে গেছে। এখন বাউন্ডারি দেয়াল নির্মাণসহ আরও কিছু কাজের জন্য প্রজেক্ট রিভাইস করে পাঠানো হয়েছে, এটি অনুমোদন হয়ে এলে বাকি কাজ শেষ হবে।
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, ডুংরিয়া মডেল গ্রামে কি হচ্ছে এখন জানেন না তিনি। অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করা তার অভ্যাসও নয়। এগুলো দেখভালের জন্য সমবায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন, ঘরে ঘরে গিয়ে তদারকি করা তার দায়িত্ব নয়। নুর হোসেন তার এমপ্লয়ি ছিলেন না। সে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। তার কাজ কারবার সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।

বাংলারজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বাংলারজমিন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status