ঢাকা, ১৫ জুন ২০২৫, রবিবার, ১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ জিলহজ্জ ১৪৪৬ হিঃ

অনলাইন

মাগুরছড়া ট্র্যাজেডি দিবস আজ

সাজিদুর রহমান সাজু, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) থেকে

(১৮ ঘন্টা আগে) ১৪ জুন ২০২৫, শনিবার, ৫:১৫ অপরাহ্ন

mzamin

আজ ১৪ই জুন শনিবার মাগুরছড়া ট্র্যাজেডি দিবস। কালের পরিক্রমার বর্ষপঞ্জিতে আবার ঘুরে এলো ভয়াবহ গ্যাসকূপ ট্র্যাজেডির ১৪ই জুন। সেই সঙ্গে যুগ হলো মাগুরছড়া বিপর্যয়ের আরো একটি বছর। গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ২৮ বছরেও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি সরকার। ১৯৯৭ সালের ১৪ই জুন এই দিনে কমলগঞ্জের মাগুরছড়া গ্যাসকূপে ড্রিলিং কাজ চলাকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠে কমলগঞ্জ। আগুনের  লেলিহানে লাল হয়ে উঠে মৌলভীবাজার জেলা। আগুনে পুড়ে যায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল, চা বাগান ও খাসিয়া জুম। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলপথ, সড়কপথ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। পুড়ে যায় বনের দুর্লভ বন্যপ্রাণীসহ হাজার হাজার জীববৈচিত্র্য। 
বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের পর তৎকালীন সরকার উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গঠিত সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজও জনসম্মুখে প্রকাশ না করায় কমলগঞ্জ উপজেলাবাসী তথা বৃহত্তর সিলেটবাসী আজও রহস্যের আগুনে পুড়ছে। অক্সিডেন্টাল কোম্পানি মাগুরছড়া গ্যাসফিল্ডে স্মরণকালের ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের পুরো ক্ষয়ক্ষতি পরিশোধ না করেই অপর মার্কিন কোম্পানি ইউনিকলের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দেশ ত্যাগ করে।
কমলগঞ্জে ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভে লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলণকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানি মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানির কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্য রাতে ঘটে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ। দুর্ঘটনার পর ইউনিকল কিছুদিন কাজ করার পর আরেক মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায়। বর্তমানে শেভরন বাংলাদেশ রয়েছে দায়িত্বে। মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির পর গঠিত একটি তদন্ত কমিটি ওই বছরের ৩০শে জুলাই এক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী উক্ত গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস ধ্বংস হয়। বন ও পরিবেশের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। পানি সম্পদেরও বিপুল ক্ষতিসাধিত হয়। দুই বলিউমে ৫০০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টেও বিস্তৃত ক্ষতির বিবরণ রয়েছে। এ অগ্নিকাণ্ডের ২৮ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবেশবাদী নেতা বলেন, দেশের চুক্তি মোতাবেক মার্কিন কোম্পানিটি বিভিন্ন অজুহাত আর টালবাহানা দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রদান করেনি। মাগুরছড়ায় গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পর সরকারের গঠিত সর্বশেষ তদন্ত কমিটি শুধু গ্যাসের ক্ষতি বাবদ ৬০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছিল। এছাড়া তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি ও বিশেষজ্ঞ মহল তৎকালিন বাজারদর অনুযায়ী গ্যাস ও পরিবেশগত ক্ষতি বাবদ ১৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। এ ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও মেলেনি। অথচ মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির পর গঠিত একটি তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে অক্সিডেন্টাল ও ডয়টেক কোম্পানি ব্লো-আউটে ক্ষতিগ্রস্ত রিগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যন্ত্রপাতির ক্ষতিবাবদ প্রায় ৩ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ বীমা কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানি। তারা ওই তদন্ত রিপোর্ট ব্যবহার করে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিলেও গত ২৮ বছরে কোনো সরকারই ওই কোম্পানির কাছ থেকে আমাদের দেশের ক্ষতিপূরণ আদায় না করার বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। দীর্ঘ ২৮ বছরেও সরকার মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পারলেও ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে এখনও সোচ্চার বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আজও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। ২৮ বছর আগে বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া মাগুরছড়ার ওই স্থান এখন সবুজের সমাহার। এ সবুজের মধ্যেই মূলকূপ স্থলটি এখনও পুকুরের মতো ধারণ করে টিকে আছে। এলাকাটি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হলেও মুল গ্যাসক্ষেত্র এখনও দুর্ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবছর ১৪;জুন এলে বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় হয় ঠিকই। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আদায়ের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘনগভীর বন ও এর সাহচর্যে থাকা বিপুল সংখ্যক জীববৈচিত্র্য। ক্ষতির মুখোমুখি হয় রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এ অঞ্চলের অসংখ্য স্থাপনা।
দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই অক্সিডেন্টাল ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এ গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন ২০০৮ সালে লাউয়াছড়া বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। পরে ২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নম্বর ব্লকের অধীনে বিস্ফোরিত গ্যাসকূপের কাছাকাছি ফুলবাড়ি এবং নুরজাহান ও জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনী কেটে ১৪ নং ব্লকের এমবি-৪ ও এমবি-৫ নামে ২টি কূপ খনন সম্পন্ন করে। এবং এই ২টির গ্যাস লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক-রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে কালাপুরে স্থাপিত প্রসেসিং প্লান্টে সঞ্চালন করে কালাংড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর করেছে। কিন্তু মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৮ বছরেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি পুরো ক্ষতিপূরণ।
এ বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা আমরা যারা এ বনে বসবাস করছি তারা ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি।
লাউয়াছড়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হক বলেন, এ রেঞ্জে আমি নতুন। গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকান্ডে এ বনের ক্ষতি নিরূপণ করা হলেও এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোনো সময়ে পুষিয়ে ওঠার নয়। আমার জানামতে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি। বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায় হওয়া আমাদেরও দাবি।

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status