ঢাকা, ২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

বাংলাদেশে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে

মানবজমিন ডেস্ক
২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার
mzamin

বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে রয়েছে বলে এর কড়া সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্প্রতি গৃহীত আইন প্রণয়ন বিষয়ক উদ্যোগগুলো মৌলিক স্বাধীনতাকে খর্ব করার ঝুঁকি তৈরি করেছে। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এবং গুরুতর অনিয়মের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের সমর্থকদের অধিকারকে দমিয়ে রাখছে। ‘বাংলাদেশ: রিভিউ ল’স অ্যান্ড প্রোটেক্ট হিউম্যান রাইটস স্ট্যান্ডার্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সংগঠনটি বলেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের একটি সংশোধনের অধীনে নতুনভাবে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ১২ই মে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘অস্থায়ী’ নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার অধীনে দলটির সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা ও অনলাইনে তাদেরকে সমর্থন করে বক্তব্য বিবৃতির বিষয় রয়েছে। অন্যদিকে, বিগত সরকারের সময়ের জোরপূর্বক গুমের বিষয়টি সমাধানে আইনের খসড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করেনি এবং অতীতের ওই অপরাধের জবাবদিহিতা খুব কমই নিশ্চিত করে এটা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে বৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দলটির সমর্থকদের বিরুদ্ধে একই পদ্ধতির ব্যবহার হতে পারে একই রকম মৌলিক স্বাধীনতার লঙ্ঘন। অন্যদিকে, জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে আইনের খসড়া ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অথবা শত শত ভিকটিম, হাসিনার আমলের গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারের জন্য জবাব কমই নিশ্চিত করে। 

তিন সপ্তাহের প্রতিবাদ বিক্ষোভে প্রায় ১৪০০ মানুষকে হত্যা করার পর ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। তারপর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়ার আগে গণতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান পুনঃস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন এই সরকার অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি গৃহীত কিছু পদক্ষেপ হতাশাজনক। ১৫ বছরের শাসনামলে দলীয় নেতারা যে অন্যায় অনিয়ম করেছেন তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এই বিচার প্রক্রিয়ায় অনেক বছরও লেগে যেতে পারে। এভাবেই কার্যত দলটিকে নিষিদ্ধ করা বোঝায়। অন্তর্বর্তী সরকার দলটির সব রকম কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে আছে- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যেকোনো রকম প্রকাশনা, মিডিয়া, অনলাইন ও সামাজিক মিডিয়া, যেকোনো প্রচারণা, র‌্যালি, মিটিং, সমাবেশ, কনফারেন্স ইত্যাদি। এর মধ্যদিয়ে দলটির সমর্থকদের কথা বলার স্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই সক্রিয় এই আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থক আছে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও লিখেছে, কার্যক্রম স্থগিতের ঘোষণার পরই নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধ্যাদেশের প্রেক্ষিতে এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর ফলে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিচার ও তা বাতিল করার ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নতুন বিধানে ‘সংগঠন’কে বিস্তৃতভাবে সংজ্ঞায়িত করে বলা হয়েছে, এটা হতে পারে যেকোনো রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট গ্রুপ অথবা এমন ব্যক্তি যে বা যিনি তাদের কার্যকলাপ প্রচার বা সমর্থন করেন বলে মনে করা হয়। এই ক্ষমতাগুলোকে এত বিস্তৃতভাবে খসড়া করা হয়েছে যে, তা যথাযথ প্রক্রিয়া ও সংগঠনের স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘন করতে পারে। অধিকন্তু, ট্রাইব্যুনাল যেকোনো ব্যক্তিগোষ্ঠী- যারা ট্রাইব্যুনালের মতে, এই ধরনের (নিষিদ্ধ) দল বা সত্তার প্রচার সমর্থন, অনুমোদন, সহায়তা বা কার্যকলাপে জড়িত, তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা রাখে। শেখ হাসিনার সরকারের যারাই অপরাধ করেছেন, তাদের যথাযথ বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের যেকোনো বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা মৌলিক স্বাধীনতায় অতিমাত্রায় বিধিনিষেধ। এর মধ্যদিয়ে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সাবেক সরকারের দমনপীড়ন প্রতিফলিত হয়। 

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যেসব ভয়াবহ অনিয়ম হয়েছে, তার সমাধানে বিলম্ব নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনের অধীনে জোরপূর্বক গুমের ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিশন ২০২৪ সালের ২৭শে আগস্ট গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের প্রাথমিক রিপোর্টে কমিশন ঘোষণা করেছে যে, তারা ১৬৭৬টি রেকর্ডেড অভিযোগ পেয়েছেন এবং ২০০ ভিকটিমের কী হয়েছে তা অজানা। এতে জোরপূর্বক গুমকে বর্ণনা করা হয়েছে একটি ‘সিস্টেমিক ডিজাইন’ হিসেবে। এর সবচেয়ে বেশি শিকার রাজনৈতিক বিরোধীরা। এতে প্রকাশ পেয়েছে ভয়াবহ নির্যাতন ও গোপন বন্দিশিবিরে আটক অবস্থার অমানবিক পরিস্থিতি। এসব বন্দিশিবির পরিচালনা করতো বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিষয়ক এজেন্সিগুলো। তদন্তে পাওয়া সব তথ্য ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা দেয়ার বর্ধিত সময় পেয়েছে এই কমিশন। কিন্তু জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনে কমিশনের অনুসন্ধানে তাদের কোনো ভূমিকার কথা উল্লেখ নেই। ব্যাপকভাবে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে যেসব জোরপূর্বক গুম হয়েছে তাকে বাদ রাখা হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশে স্বল্প পরিমাণের রিসোর্স সম্পন্ন এবং বিতর্ক আছে এমন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গুম বিষয়ক প্রস্তাবিত আইনে প্রিভেনশন অ্যান্ড রিমেডি অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স বিষয়ক একটি নতুন জাতীয় কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে, এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কোনো বিধান নেই। জোরপূর্বক গুমের জন্য যারা সন্দেহভাজন তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করা হবে একটি নতুন প্রিভেনশন অ্যান্ড রিমেডি অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স বিষয়ক ট্রাইব্যুনালে। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ‘ব্যাপক বা পদ্ধতিগত’ বলপূর্বক গুমের ক্ষেত্রে কোনো সংস্থারই এখতিয়ার থাকবে না, যার বেশির ভাগ পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে সংঘটিত।  

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও লিখেছে, জোরপূর্বক গুমের সমস্যা সমাধানে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নেয়ায় ঘাটতিতে ভিকটিমের পরিবারগুলোতে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গুম হয়েছেন এমন একজন ব্যক্তির মা বলেন, আমি এখনো আশা করি আমার ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু যদি সে ফিরে না আসে, তাহলে এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিচার চাই, যাতে কেউ কোনো মায়ের সন্তানকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার চিন্তাও না করে। পক্ষান্তরে কিছু পরিবারে ভীতি কাজ করছে। এর মধ্যে আছেন ভিকটিমদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম। গত ৮ই মে তার পারিবারিক বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। 
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও লিখেছেন, বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে গৃহীত ব্যবস্থার উল্টোটা করা এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সাবেক সরকারের যেসব সদস্য অপরাধে অভিযুক্ত তাদের বিচার করা। বিচারের আগেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বন্দি রাখা থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। বিশেষ করে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক গুমের ঘটনায়। অভিযুক্ত পরিকল্পনাকারীকে বিচারের আওতায় আনতে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় অনুসন্ধানে কমিশন যেসব তথ্য-প্রমাণ পাবে তা প্রমাণ হিসেবে জড়ো করা উচিত সরকারের। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক অনিয়মের কারণে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ক্ষোভ আছে। কিন্তু বিরোধী দলের সমর্থকদের অধিকার কেড়ে নেয়া সামনে এগিয়ে যাওয়ার সঠিক পথ হতে পারে না। এর পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত- নিখোঁজ ব্যক্তিদের সঙ্গে কী ঘটেছিল তা প্রকাশ করা এবং ন্যায্য বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের জবাবদিহি করার অগ্রগতি নিশ্চিত করা।

 

পাঠকের মতামত

What they do the Human rights watch when Dictator Hasina Killed thousands of Protestor?

Mohshin Ali
২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৬ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status