ঢাকা, ২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

রিট খারিজ ইশরাকের শপথে বাধা নেই

স্টাফ রিপোর্টার
২৩ মে ২০২৫, শুক্রবার
mzamin

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেয়া গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ এ আদেশ দেয়া হয়। গতকাল বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। আদালতের এই আদেশের ফলে মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথ নিতে আর কোনো বাধা থাকলো না বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী  ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। এদিকে রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী জহিরুল ইসলাম মুসা।  গতকালই হাইকোর্ট ইসি’র দেয়া গেজেটের বৈধতা নিয়ে রিট খারিজের আদেশ প্রকাশ করা হয়েছে। সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৭ পৃষ্ঠার এ আদেশ প্রকাশ করা হয়।

আদেশ শুনতে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এজলাসে উপস্থিত হন। ইসি’র গেজেট প্রকাশ বৈধ বলে কোর্ট অব দ্য অফিসার হিসেবে ইশরাক হোসেনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন  ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তাদের সহযোগিতা করেন একেএম এহসানুর রহমান ও মাকসুদ উল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান মিলন ও খান জিয়াউর রহমান। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসাইন (লিপু)। তাকে সহযোগিতা করেন জহিরুল ইসলাম মুসা, হুমায়রা নুর ও সাকিল আহমেদ। 

রিটের আদেশ ঘোষণার আগে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, আদেশের আগে আমার ব্রাদার জাজ কথা বলবেন। তিনিই আদেশ ঘোষণা করবেন। পরে বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী বলেন, বুধবার শুনানি শেষ হওয়ার পর কোনো একজন আদালতের বিষয়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেছেন। এটি আমাদের নজরে এসেছে। এসময় বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, ক্লায়েন্ট আসবে-যাবে। বার-বেঞ্চ থাকবে। পরে বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, তৃতীয় পক্ষ বা অপরিচিত বা সিজনাল কেউ বললে বলতে পারে।  তবে যেই বলুক তার পক্ষে ক্ষমা চাচ্ছি। এরপর বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী আদেশ ঘোষণা করেন।
যা বললেন খোকন-কায়সার: হাইকোর্টের আদেশের পর বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ না দিলে আদালত অবমাননা হবে বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। আর বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, হাইকোর্টের এই আদেশের পর ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ দেয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকলো না। আদেশের পর সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন বিএনপি’র সিনিয়র এই দুই আইনজীবী। কায়সার কামাল বলেন, আমরা মনে করি যে উপদেষ্টা আছেন, যিনি হয়তোবা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বিষয়টি ঘোরাচ্ছিলেন, তিনিও এখন অন্তত আজকে রিট খারিজের পর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে শপথগ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
আর ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশন বলেছে এ মামলাটা এসেছে ট্রাইব্যুনাল (নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল) থেকে। কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন (ট্রাইব্যুনালে মামলার বিবাদী হিসেবে), তিনি অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। ট্রাইব্যুনালের সেই রায় কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গেজেট করেছে। গেজেট অনুসারে শপথ হবে। তিনি বলেন, আদালত অবজারভেশন দিয়ে রিট খারিজ করেছেন। ফলে ইশরাকের শপথ নিতে আর কোনো বাধা নেই। আগামী ২৬শে মে’র মধ্যে শপথ দিতে হবে। একটা মহল শপথ নিতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছে। যদি শপথ না দেয়া হয়, সেটা আদালত অবমাননা হবে।

এদিকে রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী। আদেশের পর আইনজীবী জহিরুল ইসলাম মুসা সাংবাদিকদের বলেন, আপিল আবেদনটি আজই করা হতে পারে অথবা আগামী রোববার করা হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে প্রস্তুত (এডভোকেট অন রেকর্ড) রেখেছি রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করার জন্য। এর মধ্যে আদেশের কপির জন্য আমরা আবেদন করেছি। সুযোগ পেলে আজই (গতকাল) ফাইল করবো, না হয় কোর্ট খোলার দিন করবো। আশা করি আপিল বিভাগে আমরা ন্যায়বিচার পাবো। তিনি বলেন, আদালত আদেশ ঘোষণার আগে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়ায় হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এর আগের দিনও আদালত রুল দেয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তারা রাজি হননি। আরেক আইনজীবী সাকিল আহমেদ জানান, আগামী শনিবার ইশরাককে শপথ না পড়াতে রিট খারিজের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হবে। আপিল ফাইলে বেশ কিছু নতুন গ্রাউন্ড যুক্ত হবে।
রিটের শুনানিতে যেসব যুক্তি তুলে ধরেন দুইপক্ষের আইনজীবী: রিটের ওপর দু’দিন শুনানি হয়। শুনানিতে ইশরাকের আইনজীবী, রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষ অংশ নেন। গত মঙ্গলবার শুনানি শেষে বুধবার আদেশের জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু সেদিনও চলে দীর্ঘ শুনানি। এরপর আদালত আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার সময় নির্ধারণ করেন। শুরুতে হাইকোর্ট বলেন, আমরা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রুল এবং স্থিতাবস্থা দেই। আমরা সবার বক্তব্য শুনতে চাই। ব্যারিস্টার কায়সার কামাল রিট আবেদনকারীর আইনগত এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, আবেদনকারীর আইনগত এখতিয়ার নেই। তিনি সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। আদালত বলেন, আমরা তো স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও দিতে পারি। কায়সার কামাল তখন বলেন, হ্যাম্পার হবে। যখন দিনের ভোট রাতে হয়েছিল তখন তো কোনো আদালত স্যুয়োমটো (স্বতঃপ্রণোদিত) আদেশ দেননি। আদালত পাল্টা জবাব দেন, হ্যাম্পার হবে না। পরে রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন আদালতকে বলেন, এটাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়া উচিত। আমরা নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের ভুলগুলো দেখিয়েছি। আবেদনকারীর আইনগত অধিকার আছে সেটাও দেখিয়েছি। ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা শহর ব্লকেড। ইশরাকের পক্ষে হাজার হাজার জনগণ আন্দোলন করছে। আর আবেদনকারীর পক্ষে ১০ জন লোকও তো নেই। তিনি বলেন, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মামলায় স্বতঃপ্রণোদিত রুলের কোনো নজির নেই। একটা নজিরও দেখাতে পারবেন না। এটা হলে প্রত্যেকটা নির্বাচনই চ্যালেঞ্জ হবে। গেজেটের পর শপথ পড়াতে হবে। এটাই আইন।  এই অবস্থায় আবেদন খারিজ করে রিটকারীকে  কস্ট (আদালতের সময় নষ্ট করার খরচ) করার আর্জি জানান তিনি। পরে কায়সার কামাল আদালতকে বলেন, অতীতের কোর্ট রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয়েছে। এটা হাইলি পলিটিক্যালি মোটিভেটেড। এই সময়ে এ বিষয়ে রুল দেয়া কতোটা যৌক্তিক হবে? প্রশ্ন উঠবে অতীতের কোনো নির্বাচনে কেন স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেয়নি। এটাতে রুল হলে মানুষ ভাববে ৫ই আগস্টের আগের ধারাবাহিকতা এখনো বিচার বিভাগে রয়েছে। তখন আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, গত সরকারের পতনের পরপরই বর্তমান সরকার ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করেছে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল জুলাই-আগস্টের স্পিরিটকে বাইপাস করে একটা অকার্যকর মামলায় রায় দিয়েছে। এমন রায় দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরেও দিয়েছে। আমরা সেটাই চ্যালেঞ্জ করেছি। নির্বাচন কমিশন ট্রাইব্যুনালে মামলার সময়ে ইশরাককে জয়ী ঘোষণা করতে হবে- সেই মর্মে কোনো প্রতিকার চায়নি। পরবর্তী সময় ইশরাকের আবেদন দুইবার সংশোধন করা হয়েছে। যা আইনসম্মত নয়। কারণ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মামলায় কোনো আবেদন ৩০ দিন পর সংশোধন করা যায় না। যেকোনো আবেদন মামলার পক্ষ বা তার এজেন্ট (পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে) এফিডেভিটের মাধ্যমে সংশোধন করতে পারে। কিন্তু ইশরাকের মামলায় সংশোধন আবেদন করেছেন রাজিব বেপারী নামে বরিশালের এক ব্যক্তি এবং আরেকটি সংশোধনী আবেদন করেন একজন আইনজীবীর ক্লার্ক মনজুরুল ইসলাম। অথচ কোনো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নেই। সুতরাং এই এফিডেভিট গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তবুও আদালত তা গ্রহণ করে সেই মর্মে আদেশ দিয়েছেন। মাহবুব উদ্দিন খোকন তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি গত সরকারের সময় সংসদ নির্বাচন করতে গেলে ওসি আমাকে গুলি করেছিল। তখন তো কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেয়নি। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ক্যান্সারের রোগী বানিয়ে দেশ ছাড়া করেছে। তাকে বিদেশ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। তখন তো কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেয়নি।
২০২০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন সোয়া চার লাখ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র ইশরাক পান দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩রা মার্চ মামলা করেন ইশরাক। ছাত্র আন্দোলনের পর গত বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়।

এর মধ্যে গত ২৭শে মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম।  আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ রায় পাওয়ার পর ২৭শে এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। গেজেট প্রকাশের দিন ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে দেয়া রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে আইনি নোটিশ দেন রফিকুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ নামে দুই ব্যক্তি। নোটিশে গেজেট প্রকাশ এবং ইশরাককে শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। পরে মামুনুর রশিদ  নামে এক আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন।

 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status