অনলাইন
সংস্কার
‘রাজনৈতিক যুদ্ধের’ শেষ কোথায়?
সোহরাব হাসান
(৭ ঘন্টা আগে) ১৪ মে ২০২৫, বুধবার, ২:১৪ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ২:১৮ অপরাহ্ন

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে অস্ত্রের মহড়া পরিপূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেবে মনে করেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। ভারতের পক্ষে যেমন জম্মু কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ২৬ জন পর্যটককে হত্যার ঘটনা হজম করা কঠিন, তেমনি পাকিস্তানের পক্ষেও ভারতের সামরিক অভিযান চুপচাপ মেনে নেয়া অসম্ভব। তবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দু’টি দেশ পরিপূর্ণ যুদ্ধে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে না। কিছু দিন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলবে। দুই পক্ষই নিজেদের শক্তি দেখাতে চাইবে এবং শেষ পর্যন্ত একটা আপসমূলক অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হবে। আগেও এমনটি হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুদ্ধটি কীভাবে শেষ হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিতাড়িত হওয়ার পর দেশ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে আসবে। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কিছু কমিশনও গঠন করেছিল।
এখন দেখা যাচ্ছে, যেই দল বা গোষ্ঠী কমিশনের সুপারিশকে তাদের পথের কাঁটা মনে করেন, সেই দল বা গোষ্ঠীই তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে। মৌলিক অনেক বিষয়েই দলগুলোর মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য আছে, সেটি কে দূর করবে? যুযুধান একাধিক পক্ষকে সমঝোতায় আসার কৌশলটিই বা কী হবে? এতদিন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তাদের মতামত জানিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ছাড় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কে কোথায় ছাড় দেবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। অনেক দলের অবস্থান হলো ‘সালিশ মানি; কিন্তু তাল গাছ আমার।’
এখানে উল্লেখ করা দরকার এসব সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কেবল রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, তথা সংগঠনও জড়িত। যেসব সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সংবিধান বা নির্বাচনের বিষয় নেই সেগুলো বাস্তবায়নেও বিভিন্ন পেশাজীবী ও সংগঠনের পক্ষ থেকে আপত্তি এসেছে। জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রস্তাব মানেন না জনপ্রশাসনের লোকজন, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে মালিক পক্ষ, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেও সায় নেই পুলিশ বিভাগের সদস্যদের। সর্বশেষ হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন নারী বিষয়ক কমিশন বাতিল ও কমিশনের পদাধিকারীদের বিচার দাবি করেছেন। এসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা আসেনি। তারা কেবল রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপিয়ে গা বাঁচানো কৌশল নিয়েছে। ফলে অধিকাংশ কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকে এসব তৎপরতাকে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার কৌশল বলে মনে করেন।
এরই মধ্যে দু’টি ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। একটি হলো চিকিৎসার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের থাইল্যান্ড যাত্রা। আরেকটি হলো নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর গ্রেপ্তার।
প্রথম আলো’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, মো. আবদুল হামিদ বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইটে যাত্রা করেন। তিনি ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলি করার ঘটনায় কিশোরগঞ্জ থানায় করা একটি মামলার আসামি। মামলাটি করা হয়েছিল গত ১৪ই জানুয়ারি। তাতে শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদসহ মোট ১২৪ জনকে আসামি করা হয়।
বৃহস্পতিবার দিনাজপুরে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগে সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন, ‘তাদের (আবদুল হামিদকে বিদেশে যেতে সহায়তাকারীদের) কোনো অবস্থায় ছাড় দেয়া যাবে না। আর যদি শাস্তির আওতায় না আনি, তাহলে আমি সে সময় চলে যাবো।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এই ঘোষণার পর আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার, কিশোরগঞ্জের সদর থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই অভিযোগে অতিরিক্ত আইজিকে (প্রশাসন) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি)কে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কোনো চিঠি দেননি। কোনো গোয়েন্দা সংস্থারও আপত্তি ছিল না। এ কারণে আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হয়েছে।
আবদুল হামিদ ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪শে এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর আবদুল হামিদ রাজধানীর নিকুঞ্জে তার বাসায় উঠেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি পদ নেয়ার পর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না। তদুপরি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রনেতৃত্ব কিংবা কোনো রাজনৈতিক দল থেকে তাকে গ্রেপ্তার বা বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি করা হয়েছে বলে জানা নেই। দেশ ত্যাগ করার পরই তাকে নিয়ে শোরগোল উঠেছে।
এদিকে সাড়ে ছয় ঘণ্টা নাটকীয় অভিযান শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সকাল পৌনে ৬টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় সেখানে তার বিপুলসংখ্যক সমর্থক অবস্থান করছিলেন। গাড়িবহর নিয়ে পুলিশও ছিল সতর্ক অবস্থানে।
গ্রেপ্তার করার সময় সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ‘আমি কি জুলুমবাজ, আমি কি হত্যা করেছি, আমি কি চাঁদাবাজি করেছি, আমার এমন কোনো রেকর্ড আছে নারায়ণগঞ্জ শহরে কোনো বিরোধী দলকে আঘাত করেছি, তাহলে কিসের জন্য, কী কারণে, কোন ষড়যন্ত্রের কারণে, কার স্বার্থে আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো? আমিও প্রশাসনের কাছে জানতে চাই।’
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে আইভীকে গ্রেপ্তারের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের দেওভোগ এলাকায় তার নতুন বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ খবর পেয়ে আইভীর সমর্থকেরা বাড়িটির সামনে অবস্থান নেন এবং দু’টি সড়কের ১০-১৫টি পয়েন্টে বাঁশ দিয়ে অবরোধ করেন।
পুলিশ সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে হত্যাসহ ছয়টি মামলা রয়েছে।
বেশ কিছুদিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিল, পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কিছু নেতাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হতে পারে। এ নিয়ে দুই ধরনের মতামত ছিল। একটি মত হলো আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করা। আরেকটি হলো দলের প্রধান শেখ হাসিনার সম্মতি নিয়ে নতুন করে দল সাজানো। দেশের ভেতরে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা দল পুনর্গঠন নিয়ে কোনো কথা বলছেন না। তবে দেশের বাইরে থাকা নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের সুযোগ নেই। যদি দল পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয় তার সম্মতিতেই হতে হবে।
২৪শে এপ্রিল কাদির কল্লোল বিবিসি’র প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ঢাকায় তাদের দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য লোক খুঁজছে। দলটি এখন দেশের ভেতরে রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থান তৈরির বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন এর নেতারা। কিন্তু বিপর্যস্ত দলটি এখন আকস্মিক ঝটিকা মিছিল এবং সামাজিক মাধ্যমের ওপর ভর করে এগোচ্ছে; এর বাইরে বড় কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার মতো তাদের সাংগঠনিক অবস্থা এখনো হয়নি।
অন্যদিকে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ও ফ্যাসিবাদের তকমা এড়িয়ে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সহসাই ফেরত আসা সম্ভব কিনা- এই প্রশ্নও রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ প্রায় ৭৬ বছর বয়সে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার বেশি সংকটে পড়েছে।
গত বছরের পাঁচই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের পতনে শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা দলটির নেতৃত্বের একটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেন। আর দেশের ভেতরে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েন বিপর্যস্ত দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
রাজনীতিতে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ বিষয়ে একটা আলোচনা রয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে রিফান্ড আওয়ামী লীগের কথা বললে এনসিপি’র একজন নেতা কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এরপর অবশ্য ওই দলের আর কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অংশীজনেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে জনগণের সামনে এলে তাদের আমলে সংঘটিত হত্যা, গুম ও দুর্নীতির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত। দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও তাই মনে করেন। তাদের অভিযোগ, শীর্ষ নেতৃত্ব দেশ ছেড়ে গেলেও তাদেরই গত ৯ মাস জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। অনেকে আত্মগোপনে আছে।
যখন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যক্তিদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে যাদের নাম এসেছে, তাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ও সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও আছেন।
তাহলে আইভীর গ্রেপ্তার ও মো. আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সূত্র: জনতার চোখ