অনলাইন
পহেলা বৈশাখের আনন্দ জোয়ারে ভেসে গেল দেশ
গাজী মিজানুর রহমান
(১ দিন আগে) ১৫ এপ্রিল ২০২৫, মঙ্গলবার, ১:২৩ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৮ পূর্বাহ্ন

পহেলা বৈশাখ চলে গেল। অনেকের মনে আশঙ্কা ছিল, বৈশাখের অনুষ্ঠানে মানুষ আসবে তো? সংস্কৃতির তথাকথিত কাণ্ডারি ছাড়া কেমন হবে গণজমায়েত? এবারের বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। মানুষ জেনেছিল, সেখানে শেখ হাসিনার বিকৃত ছবি থাকবে। দেশে শেখ হাসিনার তো অনেক সমর্থক আছে, তারা কীভাবে নেবে এটা? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ঘিরে পহেলা বৈশাখের প্রথমদিকে জনসাধারণের মন কিছুটা সংশয়ের দোলায় দুলেছে। তবু উৎসাহে কোনো ভাটা ছিল না। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালায় ব্যাপক জন-উপস্থিতি সেই সত্য প্রমাণ করেছে।
দিনের শেষে রাত পেরুলে সকালের কাগজগুলো পরের দিনের টেলিভিশন সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া পোস্টের সমর্থনে বলেছে, অভূতপূর্ব আনন্দ সমাবেশ হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল গণমানুষের। ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী হেন করবে, তেন করবেন—এমন সব গুজবে পানি ঢেলে শাশ্বত সুন্দর আবহমান বাংলার আসল রূপটাই দেখিয়ে দিল বাংলাদেশ। ধর্ম,বর্ণ, বিশ্বাস নির্বিশেষে সকলে বটমূলে, লেকপাড়ে, উদ্যানে, পার্কে, অ্যাভিনিউতে নানা বর্ণে, নানা পোশাকে সেজে বৃহত্তর জনস্রোতে মিশে গিয়েছিল। নাচে, গানে, শিল্পকর্মে, ড্রোন-শোতে, ঘুরে বেড়ানোয়, পান্তা-ইলিশ ভোজনে—কোনোকিছুতেই কোনো ঘাটতি ছিল না। তাহলে কী ছিল এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পেছনের প্রেরণা?
সবচেয়ে বড় প্রেরণা হচ্ছে, মতলবের অনুপস্থিতি আর চাটুকারিতার অবসান। মানুষ ট্যাক্স দিয়ে সরকার চালিয়ে সেই সরকারের প্রধান বা উপ-অপ প্রধানের একচ্ছত্র গুণগান শুনতে চায় না। এই গুণগান যারা করে, তাদের পরিচিত মুখগুলোর পেছনে মনের মধ্যে আসল মতলব তাদের নেতা-নেত্রী বুঝতে না পারলেও জনগণ ঠিকই বোঝে। তাই ওইসব অনুষ্ঠানে যারা যায়, তারা সংশয়ে ভোগেন। এবারে এখনো সেই ব্যক্তিপূজা শুরু হয়নি। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানে না। তবে সকলের আশা, অতীত যেন ফিরে না আসে।
এবারের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সমূহে উপস্থিতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং জোয়ার জলে ধোয়া। নদীতে যদি জোয়ার আসে তা বাঁধ দিয়ে আটকানো যায় না। কারণ জোয়ার আসে উপগ্রহের টানে। মাতৃগ্রহকে সে এত আবেগ দিয়ে কাছে চায় যে, মাতাকে সে ডাকে সাড়া দিতেই হয়। কোনোভাবেই সেমায়া-মমতার গতি রোধ করা সম্ভব হয়না। ঠিক সেভাবে পহেলা বৈশাখ ছুটে এসেছে জনতার কাছে। উপকূল থেকে পাহাড় অবধি, গ্রাম-গঞ্জ থেকে জেলা-বিভাগের শহর হয়ে রাজধানী মহানগরে। আগের শাসকের অনুগ্রহভাজনদের হিংসার চোখ, শাপ-শাপান্ত, সীমান্তের ওপারের দুয়ো-বাণি উপেক্ষা করে নববর্ষের অনুষ্ঠানগুলো জোয়ারের জলে ভেসেছে। কেউ রুখতে পারেনি। ছায়ানট, সুরের ধারা, চারুকলাসহ ঐতিহ্যবাহী সব প্রতিষ্ঠানই ছিল স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল, ঠিক আগের মতই।
এদেশের সুস্থ মনের সকল নাগরিকদের আরাধ্য বস্তু এমনটাই। তাদের আকাঙ্ক্ষা সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে রাজনৈতিক তোষামোদি, মতলববাজি, ওপর থেকে চাপানো আদর্শবাজি থাকবে না। সরকার শুধু আইনশৃঙ্খলা দেখবে, ভেনুগুলোর অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা দেখবে, সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেবে। আর ওপর থেকে দেখবে জাতীয় স্বার্থের মূল ধারাকে আহত করা হচ্ছে কিনা। দলগুলো যার যার আদর্শ অনুযায়ী দলের ব্যানারে নিজেদের মত করে অনুষ্ঠান করবে। আর সরকারি দল বলে সে দল অন্য দলের আদর্শের টুটি চাপতে তাদের অনুষ্ঠান করার অনুমতি না দেয়ার আবরণে গুন্ডামি করবে তা চলবে না। আমরা আশা করি ভবিষ্যতেও এবারের ধারাবাহিকতার অঙ্গহানি করা হবে না। এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে মানুষের মুখের দিকে তাকালে বুঝা যাবে, তারা প্রাণের সব অর্গল খুলে, যত গ্লানি আছে, সব মুছে সত্য-সুন্দরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানাচ্ছে এবং নিজেদেরকে এক অনন্য উচ্চতায় দেখতে পাচ্ছে।
লেখক: সাবেক অতিরিক্ত সচিব
পাঠকের মতামত
‘এবারে এখনো সেই ব্যক্তিপূজা শুরু হয়নি’ ‘উপর থেকে দেখবে জাতীয় স্বার্থের মূল ধারকে আহত করা হচ্ছে কিনা’ ……… ………. অনেকটাই একমত…