শেষের পাতা
জুলাই গণহত্যা
ট্রাইব্যুনালের সামনে শহীদ পরিবারের বিক্ষোভ
স্টাফ রিপোর্টার
২৫ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে ট্রাইব্যুনালের গেটের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন ‘জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’ এবং ‘জুলাই মঞ্চ’। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে জড়ো হয়ে বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এখনো অনেক অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এছাড়া হাজার কোটি টাকার লেনদেনের মাধ্যমে তাজুল ইসলাম ধীরগতিতে বিচার কাজ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তারা। এ সময় আন্দোলনকারীরা নানা অভিযোগ উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের পদত্যাগ দাবি করেন।
এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতেও স্লোগান দেন। তারা দ্রুত গণহত্যা মামলার সব আসামি গ্রেপ্তার, অভিযোগ গঠন ও বিচার ত্বরান্বিত করে ফাঁসির দাবি তোলেন। ‘জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’র ব্যানারে দুপুর ১টার পর থেকে তারা অবস্থান নেয়। শহীদ পরিবারের অভিযোগ তারা মূলত মামলাগুলোর অগ্রগতি জানতে চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে চান। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের গেটের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করেননি।
এ সময় ’জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’ সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেন, আজকে ৮ মাস হয়ে গেল কিন্তু আসামিদের এখনো ধরা হচ্ছে না। আমরা তাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে আসছি কিন্তু তিনি দেখা করেন নাই। আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি তাজুল ইসলাম আসামিদের কাছ থেকে ১০০০ কোটি টাকা নিয়েছেন। এই কারণে তার তদন্তের কাজ ধীর গতি হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ সব ঘুষ বাণিজ্যর কথা পত্র-পত্রিকায় এসেছে। এসব টাকা বিদেশে পাচারও হয়ে গেছে। ’জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’ আন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক রাহাত আহমেদ খান মানবজমিনকে বলেন, আমরা এতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। কিন্তু চিফ প্রসিকিউটর আসেন নাই। আমরা তার পদত্যাগ দাবী করি।
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, প্রায় ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো জুলাই হত্যার বিচার হচ্ছে না। আমরা গণহত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। কিন্তু বিচারের নামে রঙ্গমঞ্চ ও তামাশা করা হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে দেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করাতে হবে। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থা তদন্তের নামে প্রহসন করছে। তদন্তের অগ্রগতি হবে কীভাবে? চিফ প্রসিকিউটর তো বিক্রি হয়ে গেছেন। গণহত্যার বিচার দ্রুত না হলে ট্রাইব্যুনাল ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন আন্দোলনকারীরা।
এ সময় শহীদ আমিনের মা বলেন, আমাদের সন্তানদের বিচার চাই। সরকার গদিতে বসে সব ভুলে গেছে। আমরা আমাদের সন্তান হারিয়েছি। তারা ক্ষমতা পেয়ে সব ভুলে গেছে। হাসিনার অত্যাচারের শিকার হয়েছি আমরা সবাই। শহীদ নাদিমুল হাসান সেলিমের বাবা বলেন, আমার ছেলেকে শেখ হাসিনা খুন করেছে। বিচারের দাবিতে আমাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে।
’জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমার ভাই কিংবা কারও সন্তান শহীদ হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি এসব হত্যা মামলার আসামিরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ২ জন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হওয়ার তথ্য আমাদের কাছে আছে।
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এটা গণ-আদালতের বিচার কিংবা মোবাইল কোর্টের বিচার নয়। আসামিকে পেলাম, আর ৩ মাসের মধ্যে সাজা দিয়ে দিলাম। বিচার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে করতে হয়। আস্তর্জাতিক আইনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সবচাইতে জটিলতম অপরাধ। এটার তদন্ত যদি গ্রহণযোগ্য এবং মানসম্পন্ন করতে হয় তবে সময় প্রয়োজন। ৫ থেকে ৬ মাস সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের যথেষ্ট সময় নয়। কিন্তু আমাদের তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন টিম জাতীয় প্রয়োজনে দিন-রাত পরিশ্রম করে ৩ মাসের কাজ ১৫ দিন কিংবা এক সপ্তাহে করার চেষ্টা করছে। আমরা আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করছি অভিযোগের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার।
এর আগে ‘জুলাই-২৪ শহীদ পরিবারের সোসাইটি’র ব্যানারে বিভিন্ন দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন। এবার তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাব্যুনালের সামনে বিক্ষোভ করেন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ৫ই সেপ্টেম্বর এডভোকেট তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। গত ১৮ই নভেম্বর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের গ্রেপ্তারের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন ও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য এক মাস সময় দিয়েছিলেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে শুধু একটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে।
এদিকে, গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অভিমুখে শহীদি মার্চ পালন করেছে জুলাই মঞ্চ। মার্চটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে পৌঁছলে গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘জুলাই-২৪ শহীদ পরিবার সোসাইটি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং উভয় সংগঠন একত্রে সংহতি প্রকাশ করে সম্মিলিতভাবে মার্চটি সম্পন্ন হয়। জুলাই মঞ্চের প্রতিনিধি সাকিব হোসেন বলেন, ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও শৃঙ্খলা বাহিনীর বিবেক বিবর্জিত সদস্যরা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। যার প্রমাণ বাংলাদেশের জনগণের হাতে হাতে রয়েছে। স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও তদন্তে ধীরগতি ও গ্রেপ্তারে অপারগ পরিস্থিতি গণহত্যার বিচারকে অনিশ্চয়তায় দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমরা ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করি। মঞ্চের অপর প্রতিনিধি থোয়াই চিং মং চাক বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জুলাই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে যারা গণহত্যা চালিয়েছে তাদের মধ্য হতে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বিচার কাজ শেষ করতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশ, র?্যাব, বিজিবি সহ শৃঙ্খলাবাহিনীর যারা বাংলাদেশে গুম, খুন ও গণহত্যায় জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে গণহত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
জুলাই মঞ্চের প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমরা ন্যায় বিচার চাই। ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে এমন কোন প্রক্রিয়াকে আমরা সমর্থন করি না। অপর প্রতিনিধি অর্ণব হুসাইন বলেন, শহীদ পরিবারকে বিচারের জন্য আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, এটা ২৪-এর জুলাই স্পিরিট এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কাটাতে বিচার কাজে নিয়োজিত সকল পক্ষকে আন্তরিক হবার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা।
পাঠকের মতামত
লীগ নিষিদ্ধের জন্য কী এই একটা কারণই যথেষ্ট নয়?