শেষের পাতা
যেভাবে মানিকগঞ্জ চেম্বার নিয়ন্ত্রণ করতেন জাহিদ মালেক
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবারমানিকগঞ্জে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন চেম্বার অব কমার্স নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। আওয়ামী লীগ সরকারের জমানার শেষের প্রায় দশ বছর সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদ গঠনে নিয়মনীতির কোনো বালাই ছিল না। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতের মুঠোয় ছিল সবকিছু। নির্বাচন ছাড়াই যাকে ইচ্ছা তাকে সভাপতি বানাতেন আবার যখন তখন ছুড়ে ফেলে দিতেন। সর্বশেষ ২০১৮ সাল থেকে চেম্বার অব কমার্সের কোনো কার্যক্রম দেখাতে পারেনি মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিরা। ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটিতে সর্বশেষ সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অন্যতম প্রধান খলিফা গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের পলাতক চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফসার উদ্দিন সরকার। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছর মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পেলেও অবৈধভাবে চার বছর পার করেছেন। এর আগে ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন জাহিদ মালেকের পুত্র রাহাত মালেক। ফলে চেম্বার অব কমার্সের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে দেখা দেয় তীব্র ক্ষোভ।
সূত্র মতে, ১৯৯১ সালে মানিকগঞ্জ জেলা চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে আসছে এই সংগঠনটির কার্যক্রম। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের জামানার শেষের ১০ বছর এই সংগঠনটি নানা কারণেই আলোচিত সমালোচিত। সর্বশেষ ২০১২ সালে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত হন সুদেব কুমার সাহা। এরপর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্বাচনের মুখ কেউ দেখেনি।
জাহিদ মালেকের পরিবার এবং আস্থাভাজন নেতারাই সিলেকশনের মাধ্যমে নিজেদের স্থান করে নেয় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতিসহ বিভিন্ন পদ-পদবিতে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের পরিচালনা পর্ষদের দুইজন সভাপতিকে নিয়ে। এদের একজন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পুত্র রাহাত মালেক এবং মন্ত্রীর প্রধান খলিফা আফসার উদ্দিন সরকার। ২০১৮ সালে রাহাত মালেককে সভাপতির আসনে বসানো হয়। দুই বছর মেয়াদের ওই কমিটির সভাপতি রাহাত মালেক একদিনের জন্যও মানিকগঞ্জের ব্যবসায়ীদের নিয়ে এক টেবিলে বসেননি। শুধুমাত্র একদিনের জন্য ঢাকার একটি হোটেলে পরিচালনা পর্ষদের নেতাদের ডেকে আপ্যায়ন এবং ব্লেজার দিয়েছেন।
ওই পরিচালনা পর্ষদের একাধিক নেতা মানবজমিনকে এমন তথ্য দিয়েছেন। এরপর ২০২০ সালে গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন সরকারকে চেম্বার অব কমার্সের মানিকগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি করেন। সেখানেও ভোটের কোনো বালাই ছিল না। মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তে প্রকৃত ব্যবসায়ী না হয়েও আফসার সরকারকে সভাপতি নিযুক্ত করেন। এ নিয়ে স্বয়ং আওয়ামী লীগের ভেতরেও ব্যাপক সমালোচনা ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কারণে কেউ কোনো ধরনের প্রতিবাদ তো দূরের কথা টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি। দুই বছরের মেয়াদে আফসার সরকারকে সভাপতি করা হলেও ২০২২ সালে পুনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি করার কথা থাকলেও সেটাও করা হয়নি। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সভাপতি হিসেবে অবৈধভাবে আরও দুই বছরসহ মোট ৪ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তার ৪ বছরে পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য নিয়ে চেম্বার অব কমার্সের কার্যালয়ে একত্রিত হননি। ব্যবসায়ীদের সংগঠন হলেও জেলার কোনো ব্যবসায়ীদের সুখে-দুঃখে আফসার সরকার কোনো ভূমিকা পালন করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
আফসার উদ্দিন সরকারের কমিটির সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম পরান মিয়া মানবজমিনকে বলেন, কমিটিতে রাজনৈতিক নেতারা জড়ানোর কারণে দেশের এই পরিস্থিতিতে কারও কোনো খোঁজখবর নেই। ব্যবসায়ীদের সংগঠনে মূলত ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য না দেয়ায় অন্যান্য পেশার লোকজন ঢুকে পড়েছে। পরিচালনা পর্ষদের মিটিং দূরের কথা কোনো কার্যক্রমই সচল ছিল না। এটা আসলে সভাপতি কেন্দ্রিক। তিনি যদি উদ্যোগ না নেন সেখানে অন্য কেউ উদ্যোগ নিয়ে মিটিং কল করতে পারে না। আফসার সরকার যে পরিপ্রেক্ষিতে সভাপতি হয়েছে সেটা সবাই জানেন। নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি না হলে যা হয়। ২০১২ সালে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে এরপর বাকি কমিটিগুলো সিলেকশনের মাধ্যমে হয়েছে। আফসার সরকার মূলত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তিনি এই সংগঠনে কোনো সময় দিতে পারেননি।
চেম্বার অব কমার্সের পর্ষদের সাবেক আরেক নেতা শহিদুল ইসলাম সুজন বলেন, ২০১৮ সালে পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক হিসেবে ছিলাম। সে সময় রাহাত মালেক সভাপতি ছিলেন। তার দুই বছরের মেয়াদে আমাদের নিয়ে শুধু একদিন ঢাকার একটি হোটেলে বসেছিলেন। এখানে ভালোমন্দ খাইয়েছেন এবং একটি করে ব্লেজার দিয়েছেন। সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো মিটিং তো দূরের কথা চেম্বার অব কমার্সের কার্যালয়ে পা রাখেননি তিনি। তাছাড়া ২০২০ সালে আমাদের না জানিয়েই আফসার উদ্দিন সরকারকে সভাপতি করে নতুন কমিটি করেছে। যা সম্পূর্ণই নিয়ম বহির্ভূত ছিল। আফসার সরকার মূলত সভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতো।
মানিকগঞ্জ জেলা চেম্বার অব কমার্সের অফিস সেক্রেটারি আশফাকুর রহমান সুমন মানবজমিনকে বলেন, এখানে দীর্ঘদিন ধরেই কোনো নিয়মনীতির মধ্যে কোনো কিছুই হয়নি। ২০১২ সালে সর্বশেষ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়। এরপর আর কোনো ভোট হয়নি। সিলেকশনের মাধ্যমেই কমিটিগুলো হয়েছে।
চেম্বার অব কমার্সের সাবেক একাধিকবারের সভাপতি সুদেব কুমার সাহা মানবজমিনকে বলেন, আমি যখন নির্বাচিত হয়েছিলাম তখন গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। এরপর ষড়যন্ত্র করে আমাকে সরিয়ে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেক ও আফসার সরকারকে সভাপতি করা হয়। কারণ তারা জানতেন আমি প্রার্থী হলে তারা আমার সঙ্গে ভোটে জিততে পারতেন না।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা মানবজমিনকে বলেন, চেম্বার অব কমার্সে প্রশাসক নিয়োগে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আমরা যোগাযোগ করবো সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসেই আমরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে সচল করার চেষ্টা করবো। এদিকে গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফসার উদ্দিন সরকার এবং সাবেক সভাপতি রাহাত মালেক আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।