বাংলারজমিন
দেনাদার থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক শাজাহান খান
আলিউল আহসান কাজল, মাদারীপুর থেকে
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবারশাজাহান খান ছিলেন জাসদ নেতা। ১৯৯১ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ঘুরতে থাকে ভাগ্যের চাকা। তৈরি হয় ক্ষমতার বলয়। একে একে নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রভাব বাড়তে থাকে তার পরিবার ও স্বজনদের। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ছিলেন দেনাদার। বর্তমানে তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক। ২০১৮ সালের একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন মতে, তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা মোতাবেক শাজাহান খানের মাসিক আয় ছিল ৫৭ হাজার ৮৬ টাকা। তার স্ত্রীর শিক্ষকতা থেকে মাসে আসতো পাঁচ হাজার দুইশ’ টাকা। তখন তাদের স্বামী-স্ত্রীর হাতে নগদ কোনো টাকা ছিল না; বরং ঋণ ছিল ৪২ লাখ টাকার উপরে। ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬ টাকা। এই হিসাবে প্রতি মাসে আসতো ৫৭ হাজার ৮৬ টাকা। ২০০৮ সালে শাজাহান খানের নিজ নামে স্থাবর সম্পদ ছিল তিন স্থানে। এ ছাড়াও গ্রামের বাড়িতে যৌথ মালিকানায় স্থাবর সম্পদ ছিল। বর্তমানে নৌমন্ত্রীর নিজ নামে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে কমপক্ষে ১৫ স্থানে এবং যৌথ মালিকানায় রয়েছে আরও ছয় স্থানে। ১০ বছর আগে নৌমন্ত্রীর স্ত্রীর নামে ছিল দুই স্থানে স্থাবর সম্পদ। বর্তমানে তার স্ত্রীর নামে স্থাবর সম্পদ রয়েছে ১৩ স্থানে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শাজাহান খান এক সময় আওয়ামী ছাত্রলীগ নেতা হলেও জাসদ গঠনের পর তিনি জাসদে যোগ দেন। জাসদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাসদের সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনীর সদস্য ছিলেন শাজাহান খান। তবে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে তিনি দ্রুতই ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এরপর দ্রুতই তার ভাগ্য বদল শুরু হয়। শাজাহান খান ও তার ভাই এবং দলীয় কর্মীরা একে একে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন বিভিন্ন সেক্টরে। তিনি সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। এই সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলেও একটা সময় প্রশাসন ছিল নীরব। তার পরিবারের সদস্য ও দলীয় কর্মীরা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডারবাজি করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বিগত সরকারের আমলে। শাজাহান খানের ছোট ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চু খান মাদারীপুরের বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। আরেক ভাই ওবায়দুর রহমান কালু খান ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি। তার ইশারায় চলতো মাদারীপুরের বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগে সিন্ডিকেট করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
শাজাহান খানের মালিকানাধীন সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সার্বিক পরিবহন, সার্বিক ফিলিং স্টেশন, সার্বিক কনস্ট্রাকশন ফার্ম, সার্বিক রিয়েল এস্টেট, সার্বিক ইটভাটা, সার্বিক প্রেসসহ নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য। এসবই করেছেন দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে। মাদারীপুর শহরের একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার ভাই ওবায়দুর রহমান খালু খানের বিরুদ্ধে। সড়ক বিভাগের জমি দখল করে ফিলিং স্টেশন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তার ছোট ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চু খানের বিরুদ্ধে। শুধু জমি দখল নয়- এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শাজাহান খান তার ক্ষমতার দাপটে মাদারীপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চেম্বার অব কমার্সও দখল নিয়েছিলেন। মাদারীপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে নিজেই সভাপতির পদ দখল করেন। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে বসান তার বন্ধু সৈয়দ আবুল বাসারকে। চেম্বার অব কমার্সের দায়িত্ব দেন তার ছোট ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চু খানকে। এসব দখল করেই ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি নৌমন্ত্রী থাকাকালে নৌ-মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর ব্যবহার করে মাদারীপুর প্রেস ক্লাব দখল করেন। প্রেস ক্লাবের দায়িত্ব দেন তার বন্ধুকে। এভাবেই তিনি মাদারীপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করেন। একাধিক মামলা হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো মামলাতেই তাকে জেলহাজতে যেতে হয়নি। সব সময়ই ছিলেন তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৩ সালে খালেদা জিয়ার বাসার বিদ্যুৎ লাইন ও পানির লাইন কেটে দিয়ে তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হন।