অনলাইন
পানি, খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, শৌচাগার কিছুই নেই: গাজার শিবিরে আছে শুধুই হতাশা
মানবজমিন ডিজিটাল
(৭ মাস আগে) ১৫ মে ২০২৪, বুধবার, ২:২৭ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৯:২৪ পূর্বাহ্ন
রাফাহ থেকে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে যাওয়ার পর খান ইউনিসের কাছে শতাধিক নতুন আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। আসাদার বিনোদন পার্ক ঢাকা পড়েছে তাঁবুর আড়ালে। অর্ধ মিলিয়ন সদ্য বাস্তুচ্যুত লোকেদের সেখানে স্থাপন করা হয়েছে যারা শহরের কাছে উপকূলের এই বালুকাময় স্ট্রিপে তাদের সংসার পেতেছেন। খান ইউনিস অঞ্চলটি উত্তর ও দক্ষিণের যুদ্ধ থেকে কোনোমতে রক্ষা পেয়েছে।
১০ বছরের মাসা আল-আরবিদ তার ভাই এবং মায়ের সাথে গাজা শহর থেকে এখানে এসেছে আশ্রয়ের খোঁজে। আল-আরবিদ গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আমাদের অনেক কিছু পিছনে ফেলে আসতে হয়েছে। এই নিয়ে ৬ বারের মতো আমাদের জায়গা পরিবর্তন করতে হলো। আমার ভাইয়ের খেলার জন্য কোনও পুতুল নেই, এমনকি আশ্রয় নেয়ার জন্য একটি ঘরও নেই। বারবার জায়গা বদলানোর কারণে আমি আমার সমস্ত বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি এবং এখন আমি তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না ’। কখনো উদ্বিগ্ন, কখনও অসুস্থ, কখনো ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত মানুষগুলি ইসরায়েলি আক্রমণ থেকে বাঁচতে আশ্রয় খুঁজে চলেছেন।
লক্ষাধিক লোক উত্তর গাজা থেকে সরে এসেছে, যেখানে হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি অভিযান অব্যাহত। সকলেই লিফলেট, ফোন কল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সম্প্রচারিত নির্দেশাবলী মেনে চলছেন যাতে এলাকাগুলো খালি করা যায়। যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুতদের জন্য ‘প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা প্রদান করা হবে’, কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই ভিন্ন। অনেককে পানির জন্য দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হচ্ছে এবং পর্যাপ্ত খাবারের সংস্থান সেখানে নেই। এক কেজি চিনির দাম ১২ ডলার। যা এক সপ্তাহ আগে রাফাতে ইসরায়েল আক্রমণ শুরু করার আগে থেকে প্রায় ছয় গুণ বেশি। আটার দাম স্থিতিশীল থাকলেও লবণ ও কফির দাম ১০ গুণ বেড়েছে। একটি সমস্যা হলো অর্থের অভাব। ব্যাংকগুলো বন্ধ এবং কয়েকটি ব্যাংকের কাছে নামমাত্র রিজার্ভ বাকি আছে।
তিন সন্তানের মা ২৮ বছর বয়সী সাবরিন সংঘাতের শুরুতে উত্তরের শহর বেইট লাহিয়া থেকে প্রথমে তার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরে চারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরায়েলে হামাসের হামলার পরে প্রায় ১২০০ জন নিহত হয়েছিল। বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিক ছিল বলে দাবি ইসরায়েল কর্তৃপক্ষের । সাবরিন আরও পাঁচটি পরিবারের সাথে নিজেদের সব সামগ্রী নিয়ে উপকূলে এসে পৌঁছেছিলেন, একটি ট্রাক ভাড়া করতে তাদের ১০ গুন্ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়েছিলো। তিন সন্তানের মা সাবরিন বলছেন, এটা কোনো সাধারণ মানুষের জীবন নয়। কিছুই নেই: পানি নেই, খাবার নেই, স্বাস্থ্যসেবা নেই, এমনকি টয়লেটও নেই। আমার বাচ্চারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে যে তারা একটু আলু পেতে পারে কিন্তু এখন আমাদের কাছে সেটুকু কেনারও টাকা নেই। আমাদের যা আছে তা হল (জাতিসংঘ দ্বারা) বিতরণ করা টিনজাত খাবার। আমার বাচ্চাদের ইতিমধ্যে ফ্লু, জ্বর এবং হেপাটাইটিস হয়েছে। তারা এখন দুর্বল, পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক নেই, তাই আমি খুব চিন্তিত।
আল-মাওয়াসির সাহায্য কর্মীরা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ‘ভয়াবহ এবং অমানবিক’ পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন । তারা বলছেন, দুর্গত মানুষগুলো সীমিত খাবার, নোংরা পানি এবং প্রায় কোনও স্যানিটেশন ছাড়াই জীবন কাটাচ্ছে। দক্ষিণ গাজায় কর্মরত বৃটিশ চিকিৎসক ডাঃ জেমস স্মিথ বলেছেন, ‘সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ আইডিপি ক্যাম্পে নর্দমার গন্ধ তীব্র। কিছু বর্জ্য নিষ্কাশন যানবাহন পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত কর্মী না থাকায় রাস্তার পাশে কঠিন বর্জ্যের স্তূপ জমছে। মানুষ দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’ উপকূলটিতে এখন শুধুই তাঁবুর পর তাঁবু। দুটি তাঁবুর মাঝে পর্যাপ্ত জায়গাটুকু নেই।
রাফাত ফারহাত, একজন ৬৪বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, তিন দিন আগে আল-মাওয়াসিতে পালিয়ে যান। সেখানে তার পরিবার একটি তাঁবু তৈরি না করা পর্যন্ত খোলা জায়গায় শুয়েছিলেন এই বৃদ্ধ। রাফাত বলছেন, ‘আমরা কখনই কল্পনা করিনি যে, এভাবে জীবনযাপন করব। এখন বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য এবং বাসস্থানসহ একটি জীবন দু:স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।’
গাজায় ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের মতে ইসরায়েলি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ৩৫,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি- যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু – মারা গেছে। রাফাত ৩০ জনেরও বেশি আত্মীয়কে হারিয়েছেন যাদের মধ্যে অধিকাংশর লাশ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে। গাজার দক্ষিণ উপকূলে আশ্রয় নেয়া, তরুণ ও বৃদ্ধ সবাই বলছেন, তাদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ‘ভয়হীন জীবন’।
সাবরিন বলেছিলেন যে, তিনি এখন ‘সবকিছুতেই ভয় পান’। গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি এই ভেবে যে, আমার ঘনিষ্ঠজন হয়তো হামলায় নিহত হবে। আমরা কখনই হয়তো আর আমাদের বাড়িতে ফিরব না।’ দশ বছর বয়সী মাসা আল-আরবিদ আহত বাবা, চাচাদের জন্য ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। কারণ তারা এখনো গাজা শহরে আছেন। তিনি বলছেন, 'আমি আশা করি একদিন গাজা শহরে ফিরে যাব এবং আমার বাবা এবং চাচাদের সাথে দেখা করব। আমাদের বাড়িটি আবার তৈরি করবো যেটি এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা সবাই আবার সেখানে একসাথে থাকব। আমি আমার বাবার মতো অসুস্থ ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার হতে চাই। যদি আমি ডাক্তার না হই, তাহলে আমি গণিতের শিক্ষক হবো। কারণ আমি গণিত খুব পছন্দ করি।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান
অত্যন্ত দুঃখজনক পরিস্থিতি, বিশ্বের সব রাষ্ট্র কে ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।