অনলাইন
২০২৪ লোকসভা নির্বাচন: মোদির প্রচারণা যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে
মানবজমিন ডিজিটাল
(১১ মাস আগে) ১২ মে ২০২৪, রবিবার, ২:১১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৯ পূর্বাহ্ন

নরেন্দ্র মোদি ২০২৪ সালের ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে গণভোটে রূপান্তরিত করবেন বলে আশা করা হয়েছিল। প্রচারে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী এবং মহাকাশ ফ্লাইটের মতো কৃতিত্ব নিয়ে তিনি গর্ব করবেন বলে অনেকে মনে করেছিলেন। অযোধ্যায় নতুন রাম মন্দির ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক দাবির প্রতিনিধিত্ব করে সে বিষয়টিও বার বার তার ভাষণে জায়গা করে নিয়েছে । এমনকি বৈদেশিক নীতিও ব্যালটকে প্রভাবিত করবে বলে প্রত্যাশিত ছিল, গত সেপ্টেম্বরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন মোদির প্রচারে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছে। জনমত জরিপ ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য তৃতীয়বার রেকর্ড জয়ের পূর্বাভাস দিয়েছে।
কিন্তু ছয় সপ্তাহের নির্বাচনের শুরুতে, মোদির প্রচারণা দিক হঠাৎ বদলে যায়। তার বিভাজনমূলক বক্তব্যের কৌশল নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন । তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধীদের বিরুদ্ধে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে খুশি করার অভিযোগ তুলেছেন। ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার ১৪% মুসলমান। বিরোধীদের মতে, মোদির প্রচারণা থেকে বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি, মুসলমানদের 'ভিলেন' করে তুলেছে। মোদি ২১ এপ্রিল একটি সমাবেশে বলেছিলেন যে, বিরোধী কংগ্রেস "অনুপ্রবেশকারী" এবং "যাদের অনেক সন্তান আছে" তাদের সম্পদ বিতরণ করতে চায়। তার মন্তব্যটি ব্যাপকভাবে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে করে বলা হয়েছিল বলে মনে করেন বিরোধীরা। অন্য একটি সমাবেশে, তিনি নারীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে বিরোধীরা তাদের সোনা বাজেয়াপ্ত করবে এবং মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় বিতরণ করবে। তিনি কংগ্রেসকে "ভোট জিহাদের'' মাধ্যমে একটি "নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে" তার বিরুদ্ধে একত্রিত করার অভিযোগ তুলেছেন । মোদির দাবি ,কংগ্রেস সুযোগ পেলে "ধর্মের ভিত্তিতে" ভারতীয় ক্রিকেট দল নির্বাচন করবে।
এখানেই শেষ নয়। একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছিলেন যে "পুরো বিশ্ব" নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এই সপ্তাহে, মোদি বিলিয়নিয়ার মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানির কাছ থেকে "ট্রাকলোড" অর্থ নেওয়ার জন্য কংগ্রেসকে দোষারোপ করেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দীর্ঘদিন ধরে দেশের দুই শীর্ষ ধনী ব্যক্তির সাথে মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেছেন। গান্ধী একটি ভিডিও বার্তায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন -'আপনি প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আদানি এবং আম্বানি সম্পর্কে কথা বলেছেন। এটা কি আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে আপনি জানেন তারা ট্রাকে টাকা দেয়?" দুই শিল্পপতির কেউই এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাননি। ভারতের বিরোধীরাও মোদিকে ইসলামোফোবিয়ার দায়ে অভিযুক্ত করেছে, তার মন্তব্যকে "বিভাজনকারী, ঘৃণামূলক বক্তব্য" বলে অভিহিত করেছে। কংগ্রেস সম্ভাব্য আচরণবিধি লঙ্ঘনের তদন্তের দাবি করেছে।
বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের ২০০ মিলিয়ন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য বেড়েছে। কিন্তু মোদির সাম্প্রতিক ক্তৃতা অনেককে অবাক করেছে, কারণ অনেকেই ভেবেছিলেন এবারের নির্বাচনে মোদি হয়তো তার কৃতিত্বগুলিকে তুলে ধরবেন। দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ (সিপিআর) এর রাহুল ভার্মা বলেছেন -'সত্যি কথা বলতে, আমি ভেবেছিলাম ভারতের জনগণের জন্য বিজেপি সরকার কি করেছে মোদির প্রচারণায় সে সম্পর্কে অনেক বেশি কথা থাকবে '। আবার কেউ কেউ বলছেন, মোদির বক্তব্য নজিরবিহীন নয়। পূর্ববর্তী নির্বাচনী প্রচারণার সময় এই ধরনের অনেক উদাহরণের দিকে তারা ইঙ্গিত করেছে। যার মধ্যে রয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গার পরে তার "জ্বালাময়ী বক্তব্য"। ওয়াশিংটনের কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর মিলান বৈষ্ণব বলছেন - ' প্রচারে যে ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে তা দেখে আমি বিস্মিত নই , বরং আমি হতবাক ।'
অনেকে বলছেন,প্রাথমিক রাউন্ডে ভোটদানে উল্লেখযোগ্য হ্রাস দেখে বিজেপি হয়তো ভয় পেয়েছে। পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনে, উচ্চ ভোটাভুটিতে বিজেপি জয়ী হয়েছিল -২০১৪ সালে মূলত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট পড়েছিলো এবং ২০১৯ সালে বিজেপি জয়ী হয়েছিলো মোদির জন্য।
দ্বিতীয়ত, বিরোধীরা ২০২৪ সালের নির্বাচনের আখ্যানটিকে নতুন আকার দেওয়ার চেষ্টা করছে, বেকারত্ব, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো ইস্যুতে প্রচারণার দিকে মনোনিবেশ করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নীলাঞ্জন সরকার মনে করেন যে বিজেপি যখন জাতীয় ইস্যুগুলিকে গুরুত্ব দেয় তখন জাতীয় নির্বাচনে শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়। তিনি সম্প্রতি একটি পডকাস্টকে বলেছিলেন যে নির্বাচন যখন আঞ্চলিক হয়ে ওঠে এবং স্থানীয় কারণগুলি কার্যকর হয় সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিজেপি তার সবচেয়ে শক্তিশালী খেলা এখনো খেলছে না ।মোদির দল এবার ৩৭০ টি আসনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে , যা ২০১৯ সালের ৩০৩ টি আসনের থেকে বেশি। তবে, দল এবং তার মিত্রদের জন্য একটি ভূমিধস জয় সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে "অবকি বার, ৪০০ পার" (এবার চারশোর ওপরে ) স্লোগান তোলা হয়েছে। বিরোধীরা এই স্লোগানটিকে হাতিয়ার করেছে এবং বিজেপি ভারতকে নতুন আকার দিতে চলেছে বলে গলা চড়িয়েছে তারা । বিরোধীদের দাবি বিজেপি যদি এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসে তবে তারা সংবিধান পরিবর্তন করে দেবে ।
মোদির বিভেদমূলক বক্তব্য কি হতাশার লক্ষণ? বৈষ্ণব বলছেন- "আমার কাছে, এটি তার ক্যাডারদের সংগঠিত করার জন্য এবং সম্ভবত প্রথম কয়েকটি ধাপে একটি অপ্রীতিকর পারফরম্যান্সের জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিজেপি হেরে যাচ্ছে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। তবে ৪00 আসনের নতুন লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে যদি না বিজেপি ২০১৯ সালের আসন ধরে রাখতে পারে এবং নতুন এলাকায় নিজের প্রভাব বিস্তার করতে পারে।'' নিউজ নেটওয়ার্কগুলির কাছে সাম্প্রতিক সাক্ষাত্কারে মোদির মুখে ভিন্ন সুর শোনা গেছে। টাইমস নাউকে তিনি বলেন, "আমি ইসলাম বিরোধী নই, না আমি মুসলিম বিরোধী ।" প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে সম্প্রদায় বা ধর্ম নির্বিশেষে তার সরকারের কল্যাণ সুবিধা সকলের জন্য প্রসারিত হয়েছে। তিনি যোগ করেছেন যে "সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মোদির গ্যারান্টি"।
মোদি মুসলমানদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার জন্য বিরোধীদের সমালোচনা করেছিলেন । তিনি বলেন "মুসলিমদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত কেন সম্প্রদায়ের মধ্যে ত্রুটির অনুভূতি রয়েছে। সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে। আমি যখন উপসাগরীয় দেশগুলিতে যাই, ভারত এবং আমি অনেক সম্মান পাই। বিরোধিতা শুধু এখানেই আছে " । ভারতে নির্বাচনী জয়ের পেছনের জটিলতা উন্মোচন করা সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গিলেস ভার্নিয়ার বিশ্বাস করেন যে- 'ভোটাররা তাদের পছন্দ নির্ধারণ করে ভবিষ্যতের জন্য দল এবং প্রার্থীরা কী অফার করে তা দেখে । কল্যাণ, নিরাপত্তা এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে অতীত প্রচারণাগুলির পর বিজেপির কাছে ভোটারদের কাছে অফার করার মতো নতুন কোনো ধারণা নেই। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট এই লোকসভা নির্বাচন কোন দিকে মোড় নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রতাপ ভানু মেহতা বলেছেন, " অনেকে হয়তো বলছেন বিজেপি "নার্ভাস'' কিন্তু একঘেয়েমিকে কখনই অবমূল্যায়ন করবেন না। ''
সূত্র : বিবিসি