ঢাকা, ২ ডিসেম্বর ২০২৪, সোমবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

পঞ্চগড়ে সিপিডি’র সংলাপে বক্তারা

কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি

পিয়াস সরকার, পঞ্চগড় থেকে
৩ মে ২০২৪, শুক্রবারmzamin

কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকে কারিগরি শিক্ষার্থীদের মিস্ত্রি বলে সম্বোধন করেন। মিস্ত্রি না তাদের টেকনিশিয়ান বলে সম্বোধন করা জরুরি। গতকাল পঞ্চগড় সরকারি অডিটোরিয়ামে যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা শীর্ষক পঞ্চগড় সংলাপে বক্তারা এমন মত দেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র উদ্যোগে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহযোগিতায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন,  এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এবং তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকো স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। 

সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, গুণমানসম্পন্ন শিক্ষা না দিলে পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সৃষ্টি করবে বিভাজন। এত মানুষ চাকরির জন্য আসে। কিন্তু যোগ্যলোক পাওয়া যায় না। বিদেশ থেকে লোক আনতে হয়। কারিগরি শিক্ষাকে আরও ব্যবহার করতে হবে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষাকে নিয়ে যেতে হবে। 

ডায়ালগের শুরুতে ওই এলাকার বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন পেশ করা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। গবেষণা সহযোগিতায় ছিলেন মো. রিফাত খান আওলাদ ও নাইমা জাহান তৃষা। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪১.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলছেন খুব সহজে টিভিইটি'এ (কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা- প্রশিক্ষণ) অংশ নিতে পারছেন না। এ ছাড়াও ৪৩.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলছেন কিছুটা প্রবেশগম্য। 

জরিপে অংশ নেন ২০০ বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী। যার ৫৮ শতাংশ পুরুষ ও ৪২ শতাংশ নারী। যারা ১-৩ মেয়াদি কোর্স করেন ২৪ শতাংশ, ৪-৬ মাস মেয়াদি কোর্স ৪২.৫০ শতাংশ এবং ১২-৪৮ মাস মেয়াদি কোর্সে অংশ নেন ৩৩.৫০ শতাংশ। অংশ নেয়াদের বয়স সর্বাধিক ১৪-২০ বছর ৫২ শতাংশ, ২১-২৭ বছর বয়স ৪০ শতাংশের। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ৩৫.৫ শতাংশ শিক্ষা নেন ইলেকট্রনিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ তৈরি পোশাক। কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে সর্বাধিক তথ্যপ্রাপ্তি হয় ৬১.৫ শতাংশ বন্ধু বা পরিবারের সুপারিশে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হন বিজ্ঞাপন দেখে।

প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো কারিগরি শিক্ষাকে একটি অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসেবে সরকারিভাবে কার্যকর স্বীকৃতি দিতে হবে, প্রদত্ত বাজেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন এ ক্ষেত্রে একই সঙ্গে সুশাসন প্রয়োজন। সার্বিকভাবে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি কোর্সের চাইতে দীর্ঘমেয়াদি এবং কর্ম চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্সের উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। চলমান শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান তা বাজার উপযোগিতার সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য চাকরিক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠজনদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যে সকল শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে চাকরি পেয়েছে বা যারা স্বর্কমসংস্থানে সফল হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা দরকার, পাঠ্যক্রমে অন্তর্গত বিষয় পাঠদানে কারিগরি শিক্ষা আধুনিক প্রযুক্তি ও বাজার চাহিদা বিবেচনায় দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি ল্যাবভিত্তিক বা হাতে-কলমে শিক্ষার প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন। 

প্রতিবেদনের বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা প্রতিবেদনে দেখলাম ৬ মাসের মধ্যেই চাকরি হচ্ছে এটা ভালো। কিন্তু তারা স্বল্প আয়ের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। শিক্ষা বাজেটের মাত্র ৪ শতাংশ আমরা কারিগরিতে ব্যবহার করতে পারছি। তারপরও অনেক সময় এই অর্থ ব্যবহার করতে পারছি না। এই বরাদ্দটাও আবার ইমারত নির্মাণে ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের এই অর্থ শিক্ষকদের মান উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের পড়ার পরিবেশ, দক্ষতা উন্নয়নে ব্যবহার করা প্রয়োজন।

সংলাপে যোগ দেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সুধীজনরা। প্রাণবন্ত এই আলোচনা সঞ্চালনা করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। আলোচনায় অংশ নেয়ারা সমস্যা ও সুপারিশ উপস্থাপন করেন। পঞ্চগড়ে কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য দাবি জানানো হয়। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান সকলেই।  আলোচনায় অংশ নেয়া সাধারণ দর্শকরা বলেন, ট্রেড সার্সিয়েংর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। বাজার চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনিং এর ব্যবস্থা সঠিক নয়। সিলেবাস করতে হবে বিদেশে কার্যকর নির্ভর। আমরা দেশের বাইরে কার্যকর হয় এমন প্রশিক্ষণ দিতে পারলে বিপুলসংখ্যক অর্থ আয় করা সম্ভব। ডায়ালগে সাবেক ছাত্রদল নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। এগুলোর মনিটরিং জোরদার করতে হবে। 

আলোচনায় যোগ দিয়ে পঞ্চগড় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হান্নান শেখ বলেন, আমাদের সমাজে কারিগরিকে হেয় করে দেখা হয়। তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়। যারা কারিগরি থেকে লেখাপড়া করছে তাদের আয় কিন্তু অনেক বেশি। পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র জাকিয়া খাতুন বলে,  আমাদের পঞ্চগড়ে শিল্প কারখানা নাই। ছোট ছোট কলকারখানা হলেও কর্ম করতে পারবে। কারিগরি শিক্ষাকে আড় চোখে দেখি। আমাদের এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। 

স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। নির্বাচনী ইশতেহারে বড় অগ্রাধিকার রেখেছিলাম। এখন ১৫-৩৫ বছর বয়সী সংখ্যা প্রায় ৩৫ ভাগ। আমাদের স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই আমাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবার জন্যই লেখাপড়া করেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার জন্য না তারা বিসিএস ক্যাডার হতে চান। 

তিনি বলেন, আমাদের বিরাটসংখ্যক শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় যাচ্ছে। কিন্তু এই শিক্ষার পরও যাতে দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তারা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন। কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের অনীহা দেখা দেয়। আউটসোর্সিং এর কাজ হয় ইংরেজিতে। ভাষা দক্ষতা না থাকার কারণেও অনেকে কাজ করতে পারছেন না। 

সমাপনী বক্তব্যে সিপিডি’র ডিস্টিংগুইশন ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের সামাজিক চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হয় নাই। বর্তমানে যে কাজগুলো আমরা করছি তার ৩০/৪০ ভাগ কাজ আগামীতে থাকবে না। আমাদের প্রযুক্তির বিষয়টাকে নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ যেগুলো আসবে সেগুলো মোকাবিলার জন্য কারিগরি শিক্ষায় উন্নত হওয়া খুবই জরুরি। 
 

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status