শেষের পাতা
ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনা
৪ বাংলাদেশি নিখোঁজ, ঘটনাস্থলে উপ হাইকমিশনের টিম
কূটনৈতিক রিপোর্টার
৪ জুন ২০২৩, রবিবার
ভারতে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ২৯৫ জনের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছেন কিনা- সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কলকাতা টু চেন্নাই ওই রেল রুটে শত শত বাংলাদেশি রোগী ও রোগীর স্বজন এবং ভ্রমণপিপাসুরা যাতায়াত করেন। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের একটি টিম দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। তারা নিহতদের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি আছেন কিনা- তা নিশ্চিত হতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বিরামহীন চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানান উপ-হাইকমিশনার এম. আন্দালিব ইলিয়াস। গতকাল বিকালে মানবজমিনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে উপ-হাইকমিশনার বলেন, এখনো কোনো বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আমাদের কাছে তিন জন বাংলাদেশি আহত হওয়ার খবর আছে। তাছাড়া চার জন বাংলাদেশির স্বজন ফোন করে জানিয়েছেন, তাদের নিকটাত্মীয় ওই ট্রেনে ছিলেন, তাদের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা তাদের নিখোঁজ হিসেবে বিবেচিত করছি। উপ-হাইকমিশার বলেন, ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৯৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এটি একটি সংখ্যা মাত্র। লাশগুলোর বেশির ভাগের চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাদের নাম-পরিচয় বা নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত কোনো তালিকাও হয়নি। লাশের সঙ্গে পাসপোর্ট বা কোনো ডকুমেন্ট না পাওয়া এবং এ অঞ্চলের মানুষের শারীরিক গঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিন্নতার পরিচয় নিশ্চিত হতে খানিকটা সময় লাগবে বলে জানান বাংলাদেশি ওই কূটনীতিক। তিনি বলেন, মিশনের হটলাইনে আসা ফোন এবং অন্যভাবে সরবরাহ করা তথ্যগুলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় যাচাই বাছাই করে নিহতের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি রয়েছেন কিনা- তা নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছি। তাছাড়া যে তিন জন আহত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার হয়েছেন তাদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিতেও মিশন টিম কাজ করছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় কলকাতার প্রায় ২২০ কিলোমিটার (১৩৭ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ থেকে এ পর্যন্ত ২৮৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে শত শত যাত্রীকে। শনিবার ভোরে ওড়িশার মুখ্য সচিব পি.কে জেনা এক টুইট বার্তায় বলেন, দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক বাংলাদেশির বর্ণনায় ঘটনার বিস্তারিত: ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে গেছেন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সামন্তা এলাকার কলেজ শিক্ষক মো. আক্তারুজ্জামান। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তিনি ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। আখতারুজ্জামান এবং তার স্ত্রী দুর্ঘটনাকবলিত করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী ছিলেন। আক্তারুজ্জামান মহেশপুর সরকারি পদ্মপুকুর শেখ হাসিনা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক। তার স্ত্রী নূরজাহান একজন গৃহিণী। চিকিৎসার জন্য তারা করমন্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে তামিলনাড়ু রাজ্যের ভেলোরে যাচ্ছিলেন। আখতারুজ্জামান জানান, উদ্ধারকর্ম শেষে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হলে শনিবার সকাল ৭টায় তাদের অপর একটি ট্রেনে তুলে দেয়া হয়েছে। ওই ট্রেনে আরও অনেক বাংলাদেশি যাত্রী ছিলেন বলে জানিয়েছেন এই দম্পতি।
আক্তারুজ্জামানের ভাষ্য মতে, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে বিকট শব্দ পেয়ে বুঝলাম সামনে কিছু একটা ঘটেছে। চেয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হলো না। শুধু কানে ভেসে এলো চিৎকার-চেঁচামেচি। পেছনের কামরা থেকে নেমে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সেটাও সম্ভব হলো না। আমাদের সরিয়ে নেয়া হলো, ঘটনাস্থলে যেতে দেয়া হলো না। সরানোর সময় চোখে পড়লো নিহত-আহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি। বুঝলাম ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। হতাহত ব্যক্তিদের দেখে প্রচ- ভয় পেলাম, বুঝে নিলাম বড় দুর্ঘটনা থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি।’ আক্তারুজ্জামানের স্ত্রী নূরজাহানের চোখের সমস্যা রয়েছে। বেশ কয়েক দফা ভারতে চিকিৎসা করিয়েছেন। এবার সিদ্ধান্ত নেন ভেলোরে গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। সে জন্য ১লা জুন ভারত যান। এরপর ট্রেনের টিকিট নিয়ে শুক্রবার দুপুরে হাওড়ার শালিমার স্টেশনে হাজির হন। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে তাদের নির্ধারিত করমন্ডল ট্রেনটি স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা যখন ওড়িশার বালাসোর জেলার বাহাঙ্গাবাজার এলাকায় পৌঁছান তখন ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে। তারা বিকট শব্দ ও ঝাঁকুনি অনুভব করেন। ট্রেনের মধ্যে থাকা হাজার হাজার মানুষ কান্নাকাটি শুরু করেন।
তিনটি ট্রেন- দুটি যাত্রীবাহী, একটি মালবাহী। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এসব ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় দুমড়ে মুচড়ে যায় ট্রেনের বগি। আক্তারুজ্জামান জানান, তারা ছিলেন ২-এ এসি বগিতে। তাদের সামনে ছিল আরও কয়েকটি বগি। তারা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে সামনে কী ঘটেছে, দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সেখানে উপস্থিত স্থানীয় মানুষগুলো তাদের যেতে দিলো না। তারা উদ্ধারকাজ শুরু করে দিলেন। আর যারা ভালো আছেন, তাদের সরিয়ে দেয়া হলো। এরপর বাসযোগে কিছুটা দূরে এক এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেন। আক্তারুজ্জামান বলেন, ঘটনার পর তারা ছিলেন অন্ধকারের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ঘটনাস্থল থেকে বাসে ওঠা পর্যন্ত সময়টুকু তাদের আতঙ্কে কেটেছে। তবে যখন তাদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন দেখতে পান হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে ছোটাছুটি, যা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। আহত মানুষের চিৎকার কষ্ট দিয়েছে। শুধু ভেবেছেন এত বড় এক দুর্ঘটনায় পড়েও তারা ভালো আছেন! কী হচ্ছে সামনে তা তারা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। অনেক বাংলাদেশি ছিল এই ট্রেনে। তারা কেমন আছেন, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না। আক্তারুজ্জামানের স্ত্রী নূরজাহান গণমাধ্যমকে বলেন, তারা যে কামরায় ছিলেন সেখানে দুজন বাংলাদেশি ছিল। তবে অন্য কামরাগুলোয় আরও অনেক বাংলাদেশি ছিল। পরের ট্রেনে তাদের তুলে দেয়ার পর বুঝতে পেরেছেন অনেক বাংলাদেশি দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে ছিল। তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়েছে এমন তথ্য তারা পাননি। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে তারা ভালো আছেন, যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে আছেন, তাদের সবার জন্য তিনি দোয়া চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: এদিকে ভারতের ওড়িশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় এই তথ্য জানানো হয়। বার্তায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি বলেছেন, দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় আমি গভীর শোক জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আহতদেরও দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।