ঢাকা, ১ জুন ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৪ হিঃ

শেষের পাতা

যুক্তরাষ্ট্রের আসল সুপারপাওয়ার ডলারকে হুমকিতে ফেলেছে চীন-রাশিয়া

ফরিদ জাকারিয়া
২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবারmzamin

শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যেকার তিন দিনের সম্মেলনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই গণমাধ্যমের নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। নিজেদের মধ্যেকার আলোচনা প্রসঙ্গে পুতিন বলেন, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যে চীনা মুদ্রা ইয়েন ব্যবহার করতে চায় রাশিয়া। অর্থাৎ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং তার সব থেকে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ এখন সক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য ধ্বংসের চেষ্টা করছে। তারা কি এতে সফল হবে?
এই ডলারই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সুপারপাওয়ার’। ডলারের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে এবং তাদেরকে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। বহুদিন ধরেই চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়ছিল। এরমধ্যে ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই দুটি বিষয় মিলে একটি নিখুঁত ঝড় তৈরি হয়েছে যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্য ধ্বংসের প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে। বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন ডলারের রিজার্ভ ছোট করতে উদ্যোগ নিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন
বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশগুলো ইয়েন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ দারুণভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে। বাইডেন ইউক্রেনের পক্ষে বিশ্বের সব থেকে বড় অর্থনীতিগুলোকে নিয়ে একটি জোট তৈরি করেছেন। 
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের ভূমিকায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের একটি সিদ্ধান্ত। ২০১৮ সালের মে মাসে তিনি ইরান পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসেন। পাশাপাশি তিনি দেশটির বিরুদ্ধে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কঠিনভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের কারণে ইরান তার ইউরোপীয় বাণিজ্য পার্টনারগুলোসহ গোটা বিশ্ব অর্থনীতি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইউরোপীয় কমিশনের তৎকালীন সভাপতি জাঁ-ক্লদ জাঙ্কার ইউরোপকে একটি ‘স্বার্থপর একতরফাবাদ’ থেকে রক্ষা করতে আন্তর্জাতিকভাবে ইউরোর ভূমিকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলেন। ইউরোপীয় কমিশন এই লক্ষ্য অর্জনের একটি পথের রূপরেখাও তৈরি করেছে।
তবে এমন উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। কারণ, ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকগুলো কারণেই ডলারের আধিপত্য দৃঢ়ভাবে টিকে ছিল। একটি বিশ্বায়িত অর্থনীতির স্বাচ্ছন্দ্য এবং দক্ষতার জন্য একটি একক মুদ্রা প্রয়োজন। ডলার স্থিতিশীল, যে কেউ এটিকে যেকোনো সময় এটি কিনতে এবং বিক্রি করতে পারে। ডলারের দাম বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সরকারের ইচ্ছায় নয়। তাই আন্তর্জাতিকভাবে ইউয়ানের ভূমিকা প্রসারিত করার জন্য চীনের প্রচেষ্টা কাজ করেনি। এখন শি জিনপিং যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার কারণ হতে চান তবে তাকে অবশ্যই তার দেশের আর্থিক খাতকে উদারীকরণ করতে হবে। এতে করে ইয়েনকে ডলারের সত্যিকারের প্রতিযোগী করে তোলা যাবে। তবে এটি করতে গেলে চীনকে তার মার্কেট উন্মুক্ত করে দিতে হবে। অথচ এটি তার এতদিনকার উদ্দেশ্যের বিপরীত। 
ওয়াশিংটন যেভাবে ডলারকে অস্ত্রে পরিণত করেছে তাতে গত এক দশকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দেশই নিজেদের ‘পরবর্তী রাশিয়ায় পরিণত না হওয়া’ ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে দেশগুলো। ২০ বছর আগে যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে ৭০ শতাংশ ডলার ছিল, তা এখন ৬০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এখনো ডলার রিজার্ভের মাত্রা কমছে। 
ইউরোপ এবং চীন এখন ডলার-ডমিনেটেড সুইফট সিস্টেমের বিকল্প আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম তৈরির চেষ্টা করছে। সৌদি আরব ইয়েন দিয়ে তেল কিনতে চায়। ভারতও এখন রাশিয়া থেকে তেল কিনতে ডলারের বিকল্প খুঁজে বের করছে। এ ছাড়া অনেক দেশই ডিজিটাল কারেন্সির দিকে ঝুঁকছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরইমধ্যে একটি ডিজিটাল কারেন্সি তৈরিও করেছে। এমন বিকল্প তৈরি করতে গিয়ে যদিও দেশগুলোর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশ এখন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য এই দাম পরিশোধে যথেষ্ট আগ্রহী। 
বিশ্ব এখন ডলারের বিকল্প খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং এর একাধিক বিকল্প হতে পারে। লেখক এবং বিনিয়োগকারী রুচির শর্মা উল্লেখ করেছেন, এই মুহূর্তে আমার স্মৃতিতে প্রথমবারের মতো আমি এমন একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকট দেখছি, যেখানে ডলার শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে দুর্বল হচ্ছে। আমার ধারণা, এটা একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত। আশঙ্কাটি যদি সত্যি হয় তাহলে মার্কিনিদের এখন চিন্তিত হওয়া উচিত। আমি গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনের ভুল ভূ-রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে লিখেছিলাম। তাদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আচরণগুলো রপ্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থনৈতিক অঙ্গনে এই একতরফা মনোভাব আরও বেশি বাস্তব হয়ে উঠছে। 
তিনি আরও বলেন, মার্কিন রাজনীতিবিদরা এখন কোনো ঘাটতির কথা চিন্তা না করেই খরচ বৃদ্ধি করে যাচ্ছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ ৬.৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে মাত্র ২০ বছরে ৩১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার হয়েছে। ফেড তার ব্যালেন্স শিট বড় করে বহু সংকট সামাল দিয়েছে। এগুলোর সব সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র ডলারের অনন্য স্ট্যাটাসের কারণে। কিন্তু এটি যদি একবার ভেঙে পড়ে, যুক্তরাষ্ট্র এমন পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়বে, যা ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। 

(দ্য ওয়াশিংটন  পোস্টে প্রকাশিত মার্কিন কলাম লেখক ও সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়ার লেখা থেকে অনূদিত)

পাঠকের মতামত

মি: ফয়েজ এর সাথে সহমত।

বিবেক
৭ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৫৫ পূর্বাহ্ন

বর্তমান বিশ্বের জনগণ অনেক সচেতন। অতীত ও নিকট অতীতকে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবেন ও সামনে এগিয়ে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের খামখেয়ালীপনা ও অন্যায় আবদারকে অন্যান্য দেশের উপর চাপিয়ে দেয় এবং মেনে নিতে বাধ্য করে আর মেনে না নিলে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে একমেরু করন বিশ্ব ব্যবস্থা চালিয়ে আসছে ডলার দিয়ে। এখন অনেকে এই ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে বহু মেরুকরণের দিকে হাটতে শুরু করছে। দেখা যাক কতদুর এগিয়ে যেতে পারে।

আব্দুর রহমান মুন্সী
১ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ২:৫০ পূর্বাহ্ন

আমেরিকা ইসরাইলকে সাহায্য করার জন্য তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে একদিন

Rumon Hasan
২৯ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ১০:৪৭ অপরাহ্ন

কারা ডলারের বিকল্পে যেতে আগ্রহী এটা দেখা দরকার। তাদের প্রতি বাকি বিশ্বের আস্হা কতটুকু? ওসব দেশে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা বা জনগণের স্বাধীনতা কতটুকু? এছাড়াও এসব দেশের নিজস্ব কি কি সক্ষমতা এখনি তৈরী হয়েছে? দেশগুলোর দিকে তাকান৷ সিপিসি এর চীন, এমবিএস এর সৌদি আরব, পুতিনের রাশিয়া। উল্টোদিকে ডলারের সাপোর্টার কারা? জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পুরো উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এর অধিকাংশ দেশ। এছাড়া গত ১০০ বছরের পুরনো এবং পরিক্ষীত এলায়েন্স - USA/UK/France+Germany! আমেরিকার দুর্বলতা হতে পারে "massive loan", এটা ছাড়াও তাদেরকে সমালোচনার জায়গাও কম নেই, কিন্তু আমেরিকার মতো রিলায়েবল কান্ট্রি এখনো কেউই তৈরী হয়নি, সেটা আধুনিক লাইফস্টাইল থেকে ইনফ্লুয়েন্স অন কান্ট্রিজ যেদিকেই তাকাই! সো যা বর্তমানে অনেকেই একস্পেক্ট করছেন "ইউয়ান বেসড গ্লোবাল অর্ডার, হয়ত ২০-৩০ বছর পরে হতেও পারে; কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে এটা অসম্ভব।

ফয়েজ
২৮ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2023
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status