বাংলারজমিন
৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি, থানায় অভিযোগ
মৌলভীবাজারে বিষটোপে ১৩ শকুন হত্যা, পরিবেশবাদীদের ক্ষোভ
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে
২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবারমৌলভীবাজারে বিষটোপে ১৩টি বিপন্ন প্রজাতির শকুনের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের মাঝে তোলপাড় চলছে। এই দুর্ঘটনার জন্য বন বিভাগ, বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের গাফলতিকে দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও সচেতন মহল।
জানা যায়, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের বড়কাঁপন গ্রামে বুড়িকোনা ক্ষেতের জমিতে শিয়াল মারার বিষটোপ খেয়ে ১৩টি বিপন্ন প্রজাতির শকুন মারা যায়। শকুনের সঙ্গে মারা যায় ১টি শিয়াল ও ৪টি কুকুরও। ওই ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার রাতে মৌলভীবাজার মডেল থানায় ২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগ দায়ের করেছে বন বিভাগ। গঠন করা হয়েছে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিও। বৃহস্পতিবার বিকালে বিষয়টি বন বিভাগের লোকজন জানতে পেরে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং ধারাবাহিকভাবে ওই এলাকা থেকে ১৩টি শকুনের লাশ উদ্ধার করেন। ঘটনাস্থলের আশপাশে কীটনাশকের বোতলও মেলে। লাশের কঙ্কাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পালক দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই প্রাণীগুলো ১০-১৫ দিন আগেই ওখানে মারা যেতে পারে। তবে স্থানীয় বাসিন্দা, পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের ধারণা ওই ঘটনায় ঘটনাস্থলের আশপাশে বা অন্যত্র আরও শকুন মরে পড়ে থাকতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গেল বেশ কয়েক দিন থেকে ওই এলাকায় পাগলা কুকুর ও শিয়ালের উৎপাত বেড়ে ছিল। অনেক ছাগল, হাঁস ও মোরগ খেয়েছে শিয়াল। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে ওই এলাকার কে বা কারা হয়তো মৃত ছাগলের ওপর ওই কিটনাশক প্রয়োগ করে কুকুর ও শিয়াল মারার টোপ দিয়ে থাকতে পারে। ওই ছাগলের মাংস খেয়ে শকুনসহ ওই প্রাণীগুলো মারা যেতে পারে বলে তাদের ধারণা। জানা যায় প্রকৃতি ও পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার পরম উপকারী বন্ধু হিসেবে শকুন মহা বিপন্ন প্রাণী হিসেবে বিলুপ্তির পথে। ২০১৪ সালের শুমারিতে বাংলাদেশে ২৬০টি শকুনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাদের অবস্থান সিলেট ও সুন্দরবন এলাকায়। মৌলভীবাজারের পরিবাশবাদী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা বিষটোপ খেয়ে শকুন, শিয়াল ও কুকুরের মৃত্যুর ঘটনায় বন বিভাগ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চরম উদাসীনতা ও গাফলতির কারণে আজকে বিপন্ন প্রজাতির মহাহুমকিতে থাকা ১৩টি বা তারও অধিক শকুনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। হত্যার শিকার হতে হয়েছে। তারা বলেন, সিলেট অঞ্চলে শকুনের নিরাপদ অভায়শ্রম হলো রেমাকালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্ট। ওখান থেকে শকুনগুলো প্রায়ই একাটুনা ইউনিয়নের ওই এলাকাগুলোতে আসে। স্থানীয় লোকজন বলছেনও তাই। তারা প্রায়ই তাদের এলাকায় দলবেঁধে শকুন বিচরণ করতে দেখেন। তা হলে বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লোকজন ওখানে কেনো স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতার ভূমিকা নিলেন না। ওখানেতো অভয়াশ্রমের উদ্যোগ নেয়া যেতো। তারা দায়িত্বশীল হয়ে শকুন রক্ষায় উদ্যোগী হলে আগে থেকে ওই এলাকায় সচেতনামূলক প্রচার-প্রচারণা চালালে আজকে এত বড় ক্ষতি হতো না। ওখানে বিষটোপ দিয়ে নাকি অন্য কোনোভাবে শকুনগুলো হত্যা করা হয়েছে তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানান। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের এ জেলায় বনবিভাগ, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লোকজনের যে পরিমাণ দায়িত্বশীল থেকে কাজ করার কথা তা মাঠে কার্জক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সম্প্রতি বড়লেখার পাথারিয়া রির্জাভ ফরেস্টে সামাজিক বনায়নের সুবিধা করে দিতে কৌশলে ওখানে আগুন লাগিয়ে প্রায় ২০ হেক্টর জায়গার গাছপালা, বন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হয়েছে। এর আগে একই কায়দায় আগুন লাগিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বন, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই আগুন লাগার ঘটনাগুলোর সঙ্গে বন বিভাগের অসাধু অর্থলোভী কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত। তারা ওই অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জোর দাবি জানান। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ.স.ম ছালেহ সুহেল বলেন, বিপন্ন প্রজাতির শকুনগুলো এভাবে হত্যা করা হলো তা মেনে নিতে পারছি না। বনবিভাগ, বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ কোনোভাবেই এর দায়ভার এড়াতে পারেন না। তারা আগে থেকে ওখানকার মানুষকে সচেতন করলে এমনটি হতো না। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানান। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার মো. রেজাউল করিম চৌধুরী মুঠোফোনে মানবজমিনকে জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। রহস্য উদ্ঘাটনে ৩ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ঘটন করা হয়েছে। ওই ঘটনায় ২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে অভিযুক্ত করে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। মৃত শকুনগুলো উদ্ধার করে তা ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। রিপোর্ট আসলেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে বিষটোপ দিয়ে শকুন ও প্রাণিগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী জানান, ওই ঘটনায় বন বিভাগ থেকে ২ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।