বাংলারজমিন
‘জীবন বাঁচনোই কঠিন, আবার ইফতার’
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে
২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার‘জীবন বাঁচনোই কঠিন আবার ইফতার! কোনোরকম একগ্লাস পানি খেয়ে রোজা ভাঙলাম, এরপর ভাত খাবো। ইফতার সামগ্রী কেনা আমার মতো গরিব মানুষের জন্য দুঃস্বপ্ন। আপনারাই তার সাক্ষী, কি দিয়ে প্রথম রোজার ইফতারি করলাম তা দেখেছেন।’ মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার কাকজোর গ্রামের বিধবা সাহিদা বেগম রোজার প্রথমদিন ইফতার করেন পানি দিয়ে। জানালেন, স্বামী হোসেন মিয়া বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়েকে বিএ পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। মাটিকাটা থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে এবং হোটেলে পানি টানার কাজ করেছি। কয়েকদিন আগেও মানুষের জমির সরিষা উঠিয়েছি। ভালোমন্দ দিয়ে ইফতার করা তো দূরের কথা সংসার চালানোই কঠিন।
মানিকগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার কাঁচাপাকা মেঠোপথ পেরুলেই কাকজোর গ্রাম। মাহে রমজানের প্রথম রোজার প্রথমদিনের ইফতার নিয়ে সরজমিন কথা হয় গ্রামের কিছুসংখ্যক মানুষের সঙ্গে। এলাকাবাসী জানান, বাজারে পা রাখা যায় না, মাছ, মাংস, চাল ডাল আটা থেকে শুরু করে সবজি বাজারের প্রত্যেকটা জিনিসপত্রে হাত দেয়া যায় না। দিনশেষে একটু ভালো খাবার দিয়ে ইফতার করবে সেই অবস্থা নাই। কাকজোর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ক্ষুদে মুদি দোকান ব্যবসায়ী মোহন মিয়ার বাড়ি গিয়ে দেখা গেল- বাড়ির বারান্দায় পরিবারের ৪ সদস্য ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাত্র দুই তিনটি সামগ্রী দিয়ে ইফতার মেন্যু সাজানো হয়েছে। চিনির শরবত, ছোলা-মুড়ি এবং ভাত। মোহন মিয়া জানালেন, গেল বছরও কয়েক প্রকারের ফল ইফতারিতে থাকতো। কিন্তু এবার ফল কেনার ক্ষমতা নেই।
পাশের বাড়ির আহমদ আলীর স্ত্রী আলেকা বেগম এবং কলেজ পুড়ুয়া মেয়ে লিজা ইফতারের মেন্যুতে ফলের কোনো আইটেম রাখেনি। ছোলা মুড়ি আর ভাত সাজিয়ে বসে আছেন আজানের অপেক্ষায়। এসএসসি পাস করা মেয়ে লিজা জানান, ভাবছিলাম সারাদিন রোজা রাখার পর একটু ভালো-মন্দ দিয়ে ইফতার করবো। কিন্তু গরিব বাবার সামর্থ্য না থাকায় ফলমূল, আলু, বেগুনি, চপ দিয়ে ইফতার করার সৌভাগ্য হয়নি এবার। গেল বছর ইফতারের সময় বাবা মাঝে মাঝে ফল কিনে আনতো। কিন্তু এবার দাম বেশি থাকায় ফল ছাড়াই ইফতারি করতে হয়েছে।
একই গ্রামের রাশেদা বেগম জানালেন, আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য ইফতারি খাওয়াটা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম এতই বেশি যেকোনো কিছুতেই হাত দেয়া যায় না। মা ছেলে রোজা আছি। এক গ্লাস করে শরবত এবং ভাত খেয়েই ইফতার শেষ করবো। গ্রামের সেন্টু মিয়া জানালেন, টেক্সটাইল মিলে চাকরি করে যা পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য রোজা রেখেছি ভালো-মন্দ কোনো খাবার দিয়ে ইফতার করতে পারছি না। স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। কোনোরকম চিনির শরবত ও ছোলা মুড়ি দিয়েই ইফতার করেছে। গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম ইফতার প্রসঙ্গে বলেন, সকালে বাজারে ফল কিনতে গিয়েছিলাম কিন্তু দাম বেশি দেখে ২ হালি কলা ১২০ টাকা দিয়ে ১ কেজি গুড় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। পরিবারের ৪ সদস্যের মধ্যে ৩ জনই রোজা। দ্রব্যমূল্যের যে আকাশ ছোঁয়া দাম তাতে রোজা থেকে ভালোমন্দ দিয়ে ইফতার করার ক্ষমতা এবার নেই। তবে গেল বছরগুলোতে পরিপূর্ণভাবেই ইফতার করেছি। কোনো কিছুরই কমতি ছিল না।