ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

ইউরেশিয়া রিভিউয়ের প্রতিবেদন

তিস্তা চুক্তি অদূর ভবিষ্যতে নাও হতে পারে, বিকল্প ভাবতে হবে

মানবজমিন ডেস্ক
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে চুক্তি নাও হতে পারে। ভারতে রাজনীতিতে বিরোধী অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে রাজনৈতিক কারণেও তিস্তা চুক্তি নাও হতে পারে। তিস্তা চুক্তি হলে তাতে রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক অবস্থানে চলে যাবেন মোদি। তা হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পছন্দ করবেন না। ভারতে ক্ষমতাসীন দল চুক্তির বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের ওপর আস্থা নাও রাখতে পারে। কারণ, তারা এই রাজ্যে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে। ফলে তিস্তা চুক্তির কোনো বিকল্প ভাবতে হবে। ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত আনন্দ কুমারের লেখা ‘শুড ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ ফাইন্ড অলটারনেটিভ টু তিস্তা ওয়াটার শেয়ারিং ডিল?’ শীর্ষক বিশ্লেষণে এসব কথা বলা হয়েছে। লেখক আনন্দ কুমার ভারতে মনোহর পারিক্কার ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড এনালাইসিসের একজন পিএইচডি, সহযোগী ফেলো।

বিজ্ঞাপন
তিনি আরও লিখেছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো ভারত সফর করেছেন। এতে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহতভাবে গভীর হয়েছে, তা-ই ফুটিয়ে তুলেছে। গত এক দশক বা এরকম সময়ে দুই দেশই দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন অনেক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কানেক্টিভিটিতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে। জ্বালানি নিরাপত্তায় সহযোগিতা জোরালো হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনে যুগান্তকারী অগ্রগতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের তীব্র আগ্রহ থাকলেও তিস্তা নদীর পানিবণ্টন অধরাই রয়ে গেছে। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হলে তাতে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করবে।

 কারণ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা সেচের জন্য এই নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও এই চুক্তি হলে তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারতো। বাংলাদেশে এই নির্বাচন হতে পারে ২০২৪ সালের শুরুর দিকে।  ২০১১ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ওই সফরের সময়ে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, সফরের শেষ মুহূর্তে সফরকারী প্রতিনিধিদল থেকে বাদ পড়ে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেহেতু এই নদীটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। তাই ভারতের সংবিধান অনুযায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের সময় মমতার উপস্থিতি প্রয়োজন। তিনি উপস্থিত থাকলে এই চুক্তি স্বাক্ষরে সহায়ক হতো। উপরন্তু তিস্তার পানির সাহায্যে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কৃষিকাজে সেচ দেয়া হয়। তাই তিস্তা নিয়ে যেকোনো চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গকে বস্তুতই প্রভাবিত করবে। এ জন্য মমতার সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার পথ বেছে নিয়েছেন মমতা। 

তারপর এই ইস্যুটি মুলতবি অবস্থায় আছে। এখন ভারতের আরেক রাজ্য সিকিমে এই নদীর উপর আরও কয়েকটি ড্যাম নির্মাণ করার কারণে পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে আরও জটিল হয়ে গেছে।  সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সফর হয়েছে। দুই দেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার একে অন্যের দেশ সফর করেছেন। করোনা মহামারির পরে প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। একইভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভারত সফর করেছেন শেখ হাসিনা।  বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো জানে যে, ভারতে তিস্তা চুক্তি বেশ কিছু বাধার মুখোমুখি। তাই যখনই দুই দেশের শীর্ষ নেতারা একে অন্যের দেশ সফরে যান তখনই এই ইস্যুটি তারা উত্থাপন করেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য তিস্তা চুক্তি একরকম লিটমাস টেস্টের (এসিড টেস্ট) আকার ধারণ করেছে।  এই ইস্যুতে সৃষ্ট জটিলতার কারণে যেহেতু এই চুক্তি হচ্ছে না, তাই এই ব্যর্থতাকে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন বছরের ক্ষমতার মেয়াদে বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে তা ভুলে যায় তারা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবাইকে বিস্মিত করেছে। কোনো কোনো হিসাব অনুযায়ী, মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান থাকায় ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন অনেক সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। তারা স্থল এবং নৌ সীমান্ত বিষয়ক সমস্যার সমাধান করেছে।

 ভারতের উত্তর-পূর্বের সন্ত্রাস এবং বিদ্রোহ দমন করেছে সফলতার সঙ্গে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিকশিত হচ্ছে। তা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ দুটি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।    বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় অংশে ব্যবহার করা হয় ডিজেল এবং গ্যাস। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে চলে এমন অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সফলতার সঙ্গে সাহায্য করছে ভারত।  বিগত অনেক বছরে ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে বাংলাদেশকে সাহায্য করছে ভারত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ সফরের সময় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট উদ্বোধন করা হয়েছে। ঝাড়খণ্ডে নতুন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে ভারতের আদানি গ্রুপ। এ ছাড়াও মহামারির সময় রেলপথে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ভারত।

 এর ফলে রেলপথের মাধ্যমে বাণিজ্যিক পরিবহনের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে বলে অনুধাবন করেছে দুই দেশ। ভারত এখন বাংলাদেশে রেলওয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন ও মানব সম্পদকে প্রশিক্ষণ দিতে সহায়তা করবে।  উভয় পক্ষই ভালোভাবে জানে যে, দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন ইস্যুর সমাধান মুলতবি হয়ে আছে। এটা এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদী আছে। এসব নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতায় আসার জন্য চেষ্টা করছে দুই দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের ঠিক আগে আগে যৌথ নদী কমিশনের মিটিং হয়েছে। এর ফলে কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাকি নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে একই রকম অগ্রগতি দুই দেশের জন্য জটিল হবে না।  গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের পরে সবচেয়ে বড় নদী হলো তিস্তা। তাই এই তিস্তা নদী একটি আলাদা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। উপরন্তু এই নদী বাংলাদেশে প্রবেশের আগে ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই দুটি রাজ্য সেচের জন্য এবং পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিস্তার পানির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। এসব রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং চাষাবাদ বৃদ্ধির কারণে পানির ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে।  

তাই এটা সম্ভব যে, তিস্তার পানিবণ্টনের সঙ্গে যেসব জটিলতা জড়িয়ে আছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে কোনো চুক্তি নাও হতে পারে।   শেখ হাসিনার নীতি হলো ভারতপন্থি। তাই তিস্তা চুক্তিতে ঘাটতি থাকার কারণে তাকে আক্রমণ করতে এই ইস্যু ব্যবহার করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তিস্তার পানি ইস্যুতে আরও ভালো ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে ভারত। অতীতে, চীনের অর্থায়নে পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণের কথা বলেছে বাংলাদেশ, যাতে ওই পানি শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যায়। নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে একই রকম একটি প্রকল্পে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে ভারত। সব জায়গায়ই বৃষ্টি কখন হবে তা কেউ বলতে পারেন না। তাই যদি তিস্তার পাড়ে একটি জলাধার নির্মাণ করা যায়, তাহলে তা বাংলাদেশে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করবে। তার মাধ্যমে তিস্তার পানি আরও উন্নতভাবে ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে এরই মধ্যে ঋণ সুবিধা দিয়েছে ভারত, যার কিছু এখনো অব্যবহৃত রয়েছে। এর কিছু অংশ এই উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি তা-ই হয় তাহলে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বমূলক নীতির কারণে শেখ হাসিনার সরকারকে একপেশে করতে নিশ্চয় বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো অন্য কোনো ইস্যু খুঁজবে। তারা এরই মধ্যে এমনটি করেছে। তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতকে ব্যবহার করতে সক্ষম না হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছে। সীমান্তে হত্যার ইস্যু উত্থাপন না করার কথা তুলে ধরেছে। (বিকল্পটি ভাবা হলে) তারা একই রকমভাবে তিস্তার পানিবণ্টন ইস্যুটি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status