ঢাকা, ৮ মে ২০২৪, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

আল-আকসা ভাঙাই কি তাহলে ইসরাইলের মূল উদ্দেশ্য?

মাহবুব নাহিদ
২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার

ইসরাইল ফিলিস্তিন আসলে কীভাবে শত্রু হলো? কীভাবে এই ঐতিহাসিক শত্রুতার সূত্রপাত সেটা জানে না অনেকেই। প্রথম কথা হচ্ছে ইসরাইল কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র না। ইসরাইল প্রথমত. উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা দেশের নাম। যাদের কোনো সার্বভৌমত্ব ছিল না, নিজস্ব কোনো ভূখণ্ড ছিল না। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে বড় প্রেক্ষাপট হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক এবং লম্বা সময়ের যুদ্ধ বলা চলে। এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব। এই যুদ্ধের সবচেয়ে জঘন্য বিষয় ছিল জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নারকীয় পারমাণবিক বোমা হামলা। পুরো বিশ্ব এই হামলার পরে নড়েচড়ে বসে গেছিল। কিন্তু যুদ্ধের সূত্রপাত অবশ্য অন্যদিক থেকে।

বিজ্ঞাপন
জার্মানির চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনী ইউরোপ জুড়ে যেভাবে ইহুদি নিধন শুরু করেন তাতে আসলে এই যুদ্ধের একটা বিহিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অবশ্য হিটলারের বোঝার ভুল হোক আর যাই হোক, তিনি অনেক ভুল করেছেন। তার ভুলের কারণে শেষমেশ জাপানকে কড়া মূল্য দিতে হয়েছে। সেই কারণে ফিলিস্তিনের বুকে গঠিত হয়েছে ইসরাইল নামক ধার করা এক রাষ্ট্র। অবশ্য হিটলার বলে গেছিলেন যে তিনি সব ইহুদি মারবেন না, কিছু রেখে যাবেন যাতে সবাই বুঝতে পারে যে তিনি কেন ইহুদিদের মেরেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে অনেকগুলো ভালো কাজ হয়েছে, জাতিসংঘ গঠনসহ নানান চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতির যেটা কাজ হয়েছে সেটা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের বুকে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন। সারা বিশ্বে নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারে যখন ইহুদিরা উদ্বাস্তু অবস্থায় ছিল তখন তাদের একটা নির্দিষ্ট জায়গা দিতে হতো! সেই জায়গাটা বেছে নেয়া হয় ফিলিস্তিনকে। এখন কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে এত জায়গা থাকতে কেন ফিলিস্তিন? অন্য কোনো জায়গা ছিল না! এমন জায়গা ঠিক করা হলো, যাতে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত এদের মধ্যকার অচলায়তন ঠিক হবে না। 

দুই দলের মধ্যকার হামলা উত্তেজনা চলছে এবং চলবেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলো সমাধানের উদ্যোগ কেউ নেয় না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব দেয় যুদ্ধ বিরতির, যুদ্ধ থামানোর কেউ প্রস্তাব দেয় না।  এই যে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ, এর আসলে কারণ কী? কী কী বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, আর সত্যি তারা কী চায়, সেটা জানা জরুরি। প্রথমে আমরা দেখার চেষ্টা করি, দ্বন্দ্ব কী কী বিষয়ের উপর। প্রথমত. ইহুদিরা বিশ্বাস করে, বাইবেলে বর্ণিত পিতৃপুরুষ আব্রাহাম এবং তার বংশধরদের যে পবিত্র ভূমি ছিল সেই জায়গাতেই গঠিত হয়েছে ইসরাইল। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা চায়, তাদের পূর্ব সীমান্তে ফেরত যেতে। সীমান্ত নিয়ে অনেক বড় একটা বিবাদ তাদের মধ্যে লেগেই আছে। ইসরাইল মনে করে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে পুরো ভুখণ্ডের মালিক তারা হয়ে গেছে। আর ফিলিস্তিন চায়, পশ্চিম তীর, গাজা এবং আধুনিক ইসরাইল মিলিয়ে সম্পূর্ণ এলাকাটাই হয়ে উঠবে ফিলিস্তিন।  এরপরে দুই দেশই একটা জায়গার উপর অধিকার খাটাতে চায় সেটা হচ্ছে জেরুজালেম। ফিলিস্তিনও বলতে চায় জেরুজালেম তাদের রাজধানী, আর ইসরাইল বলতে চায় ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর তারা জেরুজালেম দখল করে নিয়েছে।  এরপরে আরব ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনের বিভিন্ন জায়গায় ইহুদিরা এসে বসতি গড়ে তোলে। আইন অনুযায়ী এসব বসতি সম্পূর্ণ অবৈধ, দ্রুত এসব জায়গা ছেড়ে দেয়ার আবেদন জানায় ফিলিস্তিন। 

পাশাপাশি ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হবার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফিলিস্তিনিরা শরণার্থী হয়ে ফিরে আসেন, এখন তা সংখ্যায় অনেক। এইসব নাগরিকদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানায় ফিলিস্তিন।  এখন আসি মূল আলোচনায়, অনেক কথাই বলা হয়, অনেক কথা থেকে যায় অন্তরালে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, মনের কথা মনে থাকলেও কথায় কাজে তার আভাস পাওয়া যায়। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের যে বিরোধ তা মূলত দুইটি ভূখণ্ড বাদ দিয়ে যেন একটি মসজিদ কমপ্লেক্সে সীমাবদ্ধ। মসজিদের নাম আকসা! এই মসজিদ মুসলিমদের জন্য যেমন আবেগের জায়গা, পবিত্র জায়গা, তেমনি ইহুদিদের জন্যও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বটে। এই মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত, আর মহানবী (স.) কে মেরাজে নিয়ে যাওয়ার আগে মসজিদুল হারাম থেকে এই মসজিদে নিয়ে আসা হয়। এই কারণে এই মসজিদ সমানভাবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই মসজিদ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে নাম চলে আসে নবী সুলাইমান (আ.) এর, যাকে ইহুদিরা কিং সালমান বলে থাকে। পাশাপাশি মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে এই মসজিদ নির্মাণের পর থেকে নবী ইসা (আ.) এবং অন্যান্য নবীরা এই মসজিদকে আল্লাহর উপাসনার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতেন। 

এখন ইসা (আ.) কে আবার খ্রিস্টান যিশু বা জিসাস হিসেবে মানেন। অর্থাৎ সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় এই মসজিদ সমভাবে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।  মুসলমানরা যেভাবে মনে করেন যে, এই মসজিদ তাদের কাছে পবিত্র স্থান আবেগের জায়গা। এই মসজিদ কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া উচিত। এই মসজিদ ব্যবহারের অধিকার শুধুমাত্র তাদেরই আছে বলে করেন তারা। পাশাপাশি ইহুদিরা মনে করেন, এই জায়গায় কিংবা সালমানের (সুলাইমান (আ.)-এর মন্দির ছিল। এই মন্দির ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই মন্দির পুনর্নির্মাণ করা এখন তাদের অন্যতম বড় একটা কাজ। এখানকার সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটা জায়গায় এসে মিলিত হয়, সেটা হচ্ছে, এই যে ইসরাইল ফিলিস্তিনের যুদ্ধ, এটার সকল উদ্দেশ্য আসলে এই আল আকসা মসজিদ ঘিরেই। আল আকসা মসজিদ ঘিরে আবার কিছু কুসংস্কার দেখা যাচ্ছে।  দুইটা বিষয় খুব বেশি আলোচনায় আসছে, এক নম্বর হচ্ছে, ৮০ বছর পরপর নাকি ইহুদি রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যায়। দুই নম্বর, এই মসজিদ ভাঙার আগে তাদের একটা লাল গরু প্রয়োজন। কেন লাল গরু প্রয়োজন সেই নিয়ে বিস্তারিত বলছি।  ইংরেজিতে এই টার্মটিকে বলে ‘কার্স অব এইট্‌থ ডেকেড’। 

আরবিতে বলে ‘লা’নাতুল আকদিস সামিন’।  ‘অষ্টম দশকের অভিশাপ’ টার্মটির জন্ম হয়েছে ইহুদিদের অতিগুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ন্যায়শাস্ত্র তালমুদ-এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী থেকে। (এইখানে বলে রাখা ভালো, তালমুদ কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত নয়। সেই কুসংস্কার অনুযায়ী ইসরাইলের বয়স এখন ৭৭ বছর হলে ধ্বংসের সামনে ইসরাইল। এই জন্যই তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এখন যেভাবেই হোক আল আকসা মসজিদ দখল করতে হবে। কেন দখল করতে হবে? বিশ্বে একটা অজানা সংস্থা আছে, যারা নাকি পৃথিবী চালায়, সেটা হচ্ছে সিক্রেট সোসাইটি। তারা খুব ভালো করেই জানে যে, তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে দাজ্জাল আসবে, যাকে বলা হয় মাসিহ। তারা দাজ্জালের আগমনের জন্য পূজা করে এবং তার আগমন কামনা করে। কিন্তু তারা এটা জানে যে, তাদের মাসিহ আসতে হলে তিনটা কাজ করতে হবে। ১। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। ২। ইহুদিদের একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্র থাকতে হবে। ৩। আল আকসা মসজিদ ভেঙে কিং সালমানের মন্দির বা থার্ড টেম্পল বানাতে হবে। এই তিনটি কাজের মধ্যে প্রথম দুইটি তারা করে ফেলেছে। এখন তাদের বাকি আছে আল আকসা মসজিদ ভাঙা। কিন্তু আল আকসা মসজিদ ভাঙতে হলে তাদের আগে পবিত্র হতে হবে। কারণ এখন তারা নাকি অপবিত্র অবস্থায় আছে।

 তাদের পবিত্র হতে হলে একটা লাল গরু খুঁজে পেতে হবে। লাল গরুর এক পানীয়ের মাধ্যমে তারা পবিত্র হবে এবং তারপর তারা আল আকসা মসজিদ ভেঙে ফেলবে। এই লাল গরু তারা বহু বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই লাল গরু হতে হবে একদম পবিত্র এবং সুস্থ দেহের একটা গরু। এই গরু খুঁজে বেড়ানোর জন্য টেম্পল ইনস্টিটিউটসহ নানান সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই বিভিন্ন মিডিয়ায় একটা খবর চাউর হয়েছে যে, সেই লাল গরু তারা এখন খুঁজে পেয়েছে। এই বিষয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত। পাশাপাশি অনেকে আবার ভয় পাচ্ছে, লাল গরু পেয়ে গেলেই কিনা আবার দাজ্জাল এসে পড়ে। মূলত মুসলমানদের এই লাল গরু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ পবিত্র কোরআনুল কারীমে বিভিন্ন জায়গায় গরুর কথা লেখা থাকলেও লাল গরু পাওয়া গেলে দাজ্জালের আগমন ঘটবে এখন কোনো তথ্য নাই। লাল গরুর এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত এবং বাস্তবের সঙ্গে সেটা পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। 

আল আকসা মসজিদ ভাঙার মতো এত ভয়ঙ্কর করার সাহস ইসরাইল করবে বলে মনে হয় না। তাদের আমেরিকা বা অন্য কেউ এই কাজ করতে সাহস দিবে কিনা সেটাও বড় ব্যাপার। আর এই মসজিদ ভাঙতে হলে মুসলমানদের লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে। এত সহজে মুসলমানরা এটা মেনে নেবে না। আসলে এদের কেন যে গরুর মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান হয় কে জানে! ইসরাইলের আরেক বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতেরও তো কোনো কাজ গরু ছাড়া সাধ্য হয় না। গরু খাওয়া নিয়ে তো তাদের দেশে আরেক কাণ্ড!  কাদের কথা আর বলবো, এত আলোচনা করে এখন বড্ড দুঃখই লাগছে, যাদের নিয়ে এত আলোচনা করলাম, এত কথা বললাম, তারা কিনা পড়ে আছে একটা গরুর পেছনে! অবশ্য ওসব গরুটরু মূল বিষয় নয়, মূল আকর্ষণ তাদের আল-আকসা মসজিদ ঘিরে।  

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট:

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status